Wednesday 6 January 2016

WAY TO AL QURAN-1

COLLECT FROM OIEP


(আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন)
অর্থাৎ সকল ‘হামদ’ আল্লাহর জন্য নির্ধারিত, যিনি সৃষ্টির প্রতিপালক।
এই আয়াতটির পাঠ তখনই সার্থক হবে যখন ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বলার সাথে সাথে অন্তরে দুটি অনুভূতির জন্ম হবে:
এক: আল্লাহ তাআলার অগণিত নেয়ামত স্মরণে কৃতজ্ঞতার অনুভূতি।
দুই: আল্লাহ তাআলার সুউচ্চ, মহান ও সর্বোত্তম গুণাবলীর স্মরণে তাঁর প্রতি অগাধ ভালবাসা ও ভক্তির অনুভূতি।
‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বলার সময় আমাদের অন্তর কি ভালবাসায়, আবেগে ও ভক্তিকে আপ্লুত হয়? না। আমরা তা অনুভব করি না! কেন? কারণ পাপের কারণে অন্তরে মরিচা পড়েছে:
إن العبد إذا أخطأ خطيئة نكتت في قلبه نكتة سوداء فإذا هو نزع واستغفر وتاب سقل قلبه وإن عاد زيد فيها حتى تعلو قلبه وهو الران الذي ذكر الله { كلا بل ران على قلوبهم ما كانوا يكسبون }
বান্দা যখন একটি গুনাহ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। অত:পর যদি সে বিরত হয়, ইসতিগফার ও তওবা করে, তার অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর যদি পুনরায় গুনাহ করে, তবে দাগ বৃদ্ধি পায়, শেষপর্যন্ত তার অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, আর এটিই হল “আর-রান”1
যা আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন:
كَلَّا ۖ بَلْ ۜ رَانَ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
কখনো নয়, বরং তারা যা অর্জন করত তা-ই তাদের অন্তরসমূহকে ঢেকে দিয়েছে।2
তাহলে চেষ্টা করা যাক: সূরা আল ফাতিহায় ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ পাঠের সাথে সাথে অন্তরে ভালবাসা ও ভক্তির অনুভূতির আন্দোলন তোলা যায় কিনা! এর জন্য খানিকটা চিন্তাভাবনার প্রয়োজন। ভেবে দেখি:
আল্লাহ তাআলাকে কেন ভালবাসব?
অসংখ্য কারণ রয়েছে। তবে এখানে মৌলিক দুটি কারণ তুলে ধরব ইনশা আল্লাহ, বাকীটুকু  সকলের চিন্তার খোরাক হিসেবে রইল।
প্রথমত, আমরা কখন ও কেন কাউকে ভালবাসি?
যখন সে আমাকে খুব বড় কিছু দেয়। ধরা যাক একজন অতি সম্পদশালী ব্যক্তি আমাকে ১ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন, শর্ত: ১টি সপ্তাহে তার কিছু কাজ করে দিতে হবে! মাত্র এক সপ্তাহের চাকুরী। অবশ্য কাজের সময়সূচী কিছুটা অদ্ভুত: শুরু ভোর ৫টায়, শেষ সন্ধ্যা ৭টায়। এ সময়ের মধ্যে যে কাজটুকু করতে হবে তা সাধ্যের মধ্যেই। দৈনিক ১৪ ঘন্টা কাজ হলেও মাত্র ১ সপ্তাহ, প্রাপ্তি ১ কোটি টাকা! অকল্পনীয়! কল্পনার জগতে যদি ধরে নেই যে সত্যিই কেউ এ ধরনের একটি প্রতিশ্রুতি দিল এবং তা পূরণ করল তবে কাজের অনুপাতে পুরস্কার অচিন্তনীয় মাত্রায় বড় হওয়ায় অবশ্যই তার প্রতি অন্তর ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
অথচ আল্লাহ এর চেয়ে বহু গুণ বেশি আমাদেরকে দিচ্ছেন! এক জীবনের আনুগত্যের বিনিময়ে তিনি দিচ্ছেন জান্নাতের অনন্ত জীবন: যার ভোগ-বিলাসের কোন সীমা নেই! না আছে সমাপ্তি, না আছে কমতি – আছে শুধু বৃদ্ধি! সে ভোগ-বিলাস সম্পূর্ণ ক্লেশমুক্ত! সেখানে যা চাওয়া, তাই পাওয়া যাবে! মনের সমস্ত চাহিদা সেখানে পূর্ণ হবে:
وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنْفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ ۖ وَأَنْتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
সেখানে মন যা চায় আর যাতে চোখ তৃপ্ত হয় তা-ই থাকবে এবং সেখানে তোমরা হবে চিরস্থায়ী।3
لَهُمْ مَا يَشَاءُونَ فِيهَا وَلَدَيْنَا مَزِيدٌ
তারা যা চাইবে, সেখানে তাদের জন্য তাই থাকবে এবং আমার কাছে রয়েছে আরও বেশি কিছু।4
لَهُمْ فِيهَا مَا يَشَاءُونَ خَالِدِينَ ۚ كَانَ عَلَىٰ رَبِّكَ وَعْدًا مَسْئُولًا
সেখানে তারা যা চাইবে তা-ই তাদের জন্য থাকবে, চিরস্থায়ীভাবে...5
উপরন্তু, সেগুলোর ক্রমাগত ভোগে কোন বিরক্তি বা একঘেয়েমি আসবে না:
خَالِدِينَ فِيهَا لَا يَبْغُونَ عَنْهَا حِوَلًا
তারা সেখান [জান্নাত] থেকে অন্য কোথাও যেতে চাইবে না।6
এই অনন্ত, অনিশেষ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে আমাদেরকে আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেছেন, তা কি খুব কঠিন কিছু? তা কি কোন ধরনের নির্যাতন? তা কি সাধ্যের বাইরে কোন কাজ? তা কী অতিরিক্ত কোন বোঝা? মোটেই নয়:
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
...আল্লাহ কোন ব্যক্তিকে তার সামর্থ্যের বাইরে দায়িত্ব দেন না৷7
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا مَا آتَاهَا
...আল্লাহ কোন নফসকে যা দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব তাকে দেন না।8
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
... আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান, আর তিনি তোমাদের জন্য কাঠিন্য চান না। 9
مَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيَجْعَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ حَرَجٍ
...আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা আরোপ করতে চান না... 10
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
...আর দীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি... 11
يَا عِبَادِى إِنِّى حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِى
হে আমার বান্দারা আমি নিজের ওপর যুলমকে হারাম করেছি... 12
বরং দুনিয়ার জীবনে আমাদেরকে আল্লাহ তাআলা যে দায়িত্ব দিয়েছেন - যার বিনিময়ে মিলবে স্বপ্নপুরী জান্নাতের প্রবেশাধিকার - সে দায়িত্বগুলো পালন করা সহজ। শুধু তাই নয়, যখন বান্দা সেসব দায়িত্ব পালনে সম্মত হয় ও সে পথে পা বাড়ায়, আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য এগুলোকে সহজ করে দেন:
قَالَ اللَّهُ تَعَالَى يَا ابْنَ آدَمَ قُمْ إِلَيَّ أَمْشِ إِلَيْكَ وَامْشِ إِلَيَّ أُهَرْوِلْ إِلَيْك
আল্লাহ তাআলা বলেন: হে আদম সন্তান আমার দিকে উঠে দাঁড়াও আমি তোমার দিকে হেঁটে আসব, আর আমার দিকে হেঁটে এস, আমি তোমার দিকে দৌড়ে যাব।13
فَأَمَّا مَنْ أَعْطَىٰ وَاتَّقَىٰ - وَصَدَّقَ بِالْحُسْنَىٰ - فَسَنُيَسِّرُهُ لِلْيُسْرَىٰ
সুতরাং যে দান করেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, আর উত্তমকে সত্য বলে স্বীকার করেছে, আমি তার জন্য সহজ পথে চলা সুগম করে দেব। 14
আল্লাহ আদেশ করেন নি: খেতে পারবে না! ঘুমাতে পারবে না! বিয়ে কোর না! দুনিয়ার সম্পদ ভোগ কোর না! বরং বলেছেন:
هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا
তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন৷ 15
বলেছেন:
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا وَلَا تُسْرِفُوا
...এবং খাও, পান কর কিন্তু অপচয় করো না৷... 16
বলেছেন:
فَانْكِحُوا مَا طَابَ لَكُمْ مِنَ النِّسَاءِ
...সুতরাং তোমরা নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে তাকে বিয়ে কর... 17
শুধু তাই নয়, যে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের পথ বেছে নেয়, তার দুনিয়ার জীবন সুখ, সমৃদ্ধি, প্রশান্তি ও তুষ্টিতে ভরে ওঠে!
আল্লাহ তাআলা বলেন:
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَىٰ وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً ۖ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যে মুমিন অবস্থায় উত্তম আমল করবে - পুরুষ হোক বা নারী - আমি তাকে [দুনিয়ায়] উত্তম জীবন দান করব, আর [আখিরাতে] তাদেরকে প্রদান করব তাদের সর্বোত্তম আমলগুলোর প্রতিদান। 18
এই আয়াতে নেককার মুমিনদের দুটি পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে:
  • উত্তম জীবন।
  • সর্বোত্তম আমলের প্রতিদান।
মুফাসসিরগণের মতে এই আয়াতে যে উত্তম জীবনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা মুমিনরা দুনিয়াতেই লাভ করবে। ওপরের আয়াতে উল্লিখিত উত্তম জীবনের অর্থ তাঁরা করেছেন: তুষ্টি, মনের শান্তি, হালাল রিযক এবং আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যে আনন্দ লাভ করা - এ সবকিছু মিলেই একজন মুমিনের জীবন এই পৃথিবীতেই সুন্দর হয়ে ওঠে।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« مَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ هَمَّهُ جَعَلَ اللَّهُ غِنَاهُ فِى قَلْبِهِ وَجَمَعَ لَهُ شَمْلَهُ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِىَ رَاغِمَةٌ وَمَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ جَعَلَ اللَّهُ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ وَفَرَّقَ عَلَيْهِ شَمْلَهَ وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ مَا قُدِّرَ لَهُ »
যার মনোযোগ আখিরাতের প্রতি নিবদ্ধ, আল্লাহ তাঁর অন্তরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন ও তার অন্তরে পরিতৃপ্তি ও তুষ্টি পয়দা করে দেবেন এবং তার এলোমেলো কাজগুলোকে সুবিন্যস্ত করে দেবেন, আর দুনিয়া একান্ত অনুগত হয়ে তার কাছে ধরা দেবে। অপরপক্ষে যার মনোযোগ দুনিয়ার দিকে নিবদ্ধ, আল্লাহ তাকে সর্বদা অপরের মুখাপেক্ষী রাখবেন আর তার গোছানো কাজগুলোকেও এলোমেলো করে দেবেন আর দুনিয়ার ততটুকুই সে লাভ করবে যা তার জন্য পূর্বনির্ধারিত ছিল। 19
এছাড়াও আল্লাহ তাআলা তাঁর আনুগত্যের বিনিময়ে দিয়েছেন বিপদে উত্তরণ ও অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে রিযিকের প্রতিশ্রুতি:
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا - وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ
...আর যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিযিক দেন যা সে কল্পনাও করেনি।20
এবং তিনি তাঁর আনুগত্যের বিনিময়ে দিয়েছেন দুনিয়ার জীবনে সহজতার প্রতিশ্রুতি:
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مِنْ أَمْرِهِ يُسْرًا
যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।21
আরও দিয়েছেন দুনিয়ার জীবনে সাহায্য ও বিজয়ের প্রতিশ্রুতি:
وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ
আর মুমিনদেরকে সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য।22
দিয়েছেন বিপদমুক্তির প্রতিশ্রুতি:
وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا
যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন।23
এতো দ্বিগুন অর্জন! আল্লাহর আনুগত্য আখিরাতের প্রকৃত জান্নাত লাভের পূর্বে দুনিয়ার জীবনকেই যেন জান্নাতে পরিণত করে!
৫০, ৬০, ৭০ বছরের ‘সহজ’ আনুগত্যের বিনিময়ে অনন্ত জান্নাত! গণিতের ছাত্র বলবে কাজ ও এর প্রতিদানের অনুপাতটি অসীম! তবে ১ কোটি টাকার কাল্পনিক দাতার তুলনায় আল্লাহ তাআলাকে কতটা বেশি ভালবাসা উচিৎ? উপরন্তু যখন তাঁর আনুগত্য নিজেই এক অগ্রিম ও তাৎক্ষণিক পুরস্কার? যখন এর বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি জান্নাতে অনন্ত জীবন?
فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে [মানুষ ও জ্বিন]  অস্বীকার করবে? 24
এভাবে চিন্তা করলে আশা করা যায় আমাদের অন্তরের মরিচা দূর হয়ে এতে অনুভূতির সঞ্চার হবে, আল্লাহ তাআলার প্রতি ভালবাসা জন্মলাভ করবে!
দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে আমরা যত মানুষকে ভালবাসি, তা:
এক: হয় তাদের কোন অনুগ্রহের কারণে।
নতুবা
দুই: তাদের কোন গুণের কারণে।
যখন আমরা বিশ্বাস করব যে কোন ব্যক্তির অনুগ্রহ এবং প্রশংসনীয় গুণ – এ দুটিই আল্লাহর দেয়া, আর সেই সাথে আল্লাহ চেয়েছেন যে ঐ ব্যক্তি আমার প্রতি অনুগ্রহ করুক, আর তাই সে তা করেছে – এতে এককভাবে তার কোন কৃতিত্ব নেই – তবে অনুগ্রহকারী সকল ব্যক্তির চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভালবাসা উচিৎ নয় কী?
আমার মাকে আমি ভালবাসি! কিন্তু মায়ের মনে দয়ামায়া ও স্নেহ-ভালবাসা আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন আমার জন্যে! তবে মায়ের চেয়ে কী আল্লাহ প্রিয় হবেন না?
বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাকে মানুষ করেছেন! নিজে উপোস থেকে আমাকে খাইয়েছেন! তাঁর মনে এই দয়া-ভালবাসা আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন আমার জন্যে! সেক্ষেত্রে আল্লাহকে বাবার চেয়েও বেশি ভালবাসা উচিৎ নয় কী?
আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী কিংবা স্বামীকে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন আমার জন্যে। তিনি চাইলে মানুষের মনে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনুভূতি-শূন্যতা সৃষ্টি করতেন। বরং চাইলে কোন বিপরীত লিঙ্গই থাকত না:
وَمِنْ آيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও৷ আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন৷ নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে৷25
জ্ঞানের বহর দেখে কাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি ভালবাসব? অথচ আল্লাহ তাআলা অসীম জ্ঞানের অধিকারী, এবং তিনিই সকল জ্ঞানীর জ্ঞানের উৎস?
সৌন্দর্য দেখে কাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি ভালবাসা যেতে পারে? অথচ আল্লাহ তাআলা সকল সৌন্দর্যের উৎস?
إِنَّ اللَّهَ جَمِيلٌ يُحِبُّ الْجَمَالَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ সুন্দর ও সুন্দরকে তিনি ভালবাসেন। 26
حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِه
তাঁর পর্দা নুরের, যদি তিনি একে সরিয়ে নিতেন তবে তাঁর চেহারার দীপ্তি তাঁর দৃষ্টি যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত সৃষ্টির সবকিছুকে পুড়িয়ে ফেলত!27
ক্ষমতা কিংবা শক্তি দেখে কাউকে আল্লাহর চেয়ে বেশি ভালবাসা সমীচীন কী? অথচ আল্লাহ তাআলা সকল শক্তি ও ক্ষমতার উৎস?
এরপর কোন মানুষ কিংবা নিরেট বস্তুকে কিভাবে আল্লাহর চেয়ে বেশি ভালবাসা সম্ভব হতে পারে?
চিন্তাশীল পাঠকের অন্তরে আল্লাহর প্রতি ভালবাসা উদ্রেকের জন্য এটুকু যথেষ্ট – অথচ আল্লাহ তাআলাকে পরমভাবে ভালবাসার আরও অসংখ্য, অগণিত কারণ উল্লেখ করা যাবে – তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা প্রত্যেকের দায়িত্বে রইল।
‘আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ – আশা করি আজ থেকে প্রতিবার হৃদয়পূর্ণ ভালবাসা ও ভক্তি নিয়ে আমরা এ বাণী উচ্চারণ করতে পারব!
সকল বিষয়ে সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর
‘আল-হামদু’ শব্দে ‘আল’ ব্যবহারের দ্বারা সকল প্রকারের প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য নির্ধারিত হয়েছে। তিনি সকল কারণে প্রশংসিত। এমনকি মন্দের অস্তিত্বের জন্যও আল্লাহ তাআলা প্রশংসিত! বিপদাপদ, রোগশোক, অন্যায়, অনাচার, জুলম-নির্যাতন, পাপ, অনিষ্ট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষুধা, দারিদ্র, মহামারি – এ সকল কিছুর অস্তিত্ব একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাতেই, আর এর জন্যও তিনি প্রশংসিত! কেননা এর কোনটিই দৈবাৎ, অনিয়ন্ত্রিত বা কারণহীন নয়। বরং পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলা মন্দের অস্তিত্ব রেখেছেন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণে। এর মধ্যে রয়েছে:
ক) মানুষকে পরীক্ষা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا ۚ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ
যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলে সর্বোত্তম। আর তিনি মহাপরাক্রমশালী, অতিশয় ক্ষমাশীল। 28
খ) মানুষের পাপের ফল তাকে ভোগ করিয়ে তাকে সতর্ক করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:
ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ لِيُذِيقَهُمْ بَعْضَ الَّذِي عَمِلُوا لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে ফাসাদ প্রকাশ পেয়েছে, যেন আল্লাহ তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।29
গ) মানুষের সীমালংঘনের শাস্তিস্বরূপ।আল্লাহ তাআলা বলেন:
مَا أَصَابَكَ مِنْ حَسَنَةٍ فَمِنَ اللَّهِ ۖ وَمَا أَصَابَكَ مِنْ سَيِّئَةٍ فَمِنْ نَفْسِكَ
তোমার কাছে যে কল্যাণ পৌঁছে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যে অকল্যাণ তোমার ওপর আপতিত হয়, তা তোমার নিজের পক্ষ থেকে। ... 30
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
لم تظهر الفاحشة في قوم قط حتى يعلنوا بها إلا فشا فيهم الأوجاع التي لم تكن في أسلافهم ولم ينقصوا المكيال والميزان إلا أخذوا بالسنين وشدة المؤنة وجور السلطان ولم يمنعوا زكاة أموالهم إلا منعوا القطر من السماء ولولا البهائم لم يمطروا ولا نقضوا عهد الله وعهد رسوله إلا سلط عليهم عدو من غيرهم فيأخذ بعض ما في أيديهم وما لم تحكم أئمتهم بكتاب الله إلا جعل بأسهم بينهم
যখনই কোন জাতির মধ্যে ফাহিশাহ তথা যেনা ব্যভিচার এমনভাবে ছড়িয়ে পড়বে যে তারা তা প্রচার করবে, তখনই তাদের মধ্যে এমন সব রোগ ছড়িয়ে পড়বে যা তাদের পূর্ববর্তীদের মাঝে ছিল না। যখনই তারা মাপে ও ওজনে কম দেবে তখনই খরা, অনাহার এবং শাসকের যুলুমের দ্বারা আক্রান্ত হবে। যখনই তারা মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আকাশ থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেয়া হবে - আর জীবজন্তু না থাকলে মোটেই তাদের ওপর বৃষ্টিপাত হত না। যখনই তারা আল্লাহর চুক্তি ও রাসূলের চুক্তি ভঙ্গ করবে তখনই তাদের ওপর বহিঃশত্রু চাপিয়ে দেয়া হবে, ফলে তারা তাদের মালিকানায় যা আছে তার একাংশ দখল করবে। আর তাদের নেতারা আল্লাহর কিতাবের দ্বারা বিচার-ফয়সালা না করলে তাদের নিজেদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে।
ঘ) বিপদাপদের দ্বারা মুমিন বান্দাদের গুনাহ মাফ হয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« مَا مِنْ شَىْءٍ يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ حَتَّى الشَّوْكَةِ تُصِيبُهُ إِلاَّ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِهَا حَسَنَةً أَوْ حُطَّتْ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ »
যে বিপদই মুমিনের ওপর আসুক না কেন, এমনকি কাঁটা বিধলেও এর কারণে আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লেখেন অথবা তার একটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। 31
مَا يَزَالُ الْبَلَاءُ بِالْمُؤْمِنِ وَالْمُؤْمِنَةِ فِي نَفْسِهِ وَوَلَدِهِ وَمَالِهِ حَتَّى يَلْقَى اللَّهَ وَمَا عَلَيْهِ خَطِيئَةٌ
মুমিন নর-নারীর জীবন, সন্তান ও সম্পদে একের পর এক বিপদ আসতেই থাকে, শেষ পর্যন্ত সমস্ত গুনাহ থেকে মুক্ত অবস্থায় আল্লাহর সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। 32
إن العبد إذا مرض أوحى الله إلى ملائكته : يا ملائكتي أنا قيدت عبدي بقيد من قيودي ، فإن أقبضه أغفر له و إن أعافه فحينئذ يقعد و لا ذنب له
বান্দা অসুস্থ হলে আল্লাহ ফেরেশতাদের প্রতি ওহী করেন: হে আমার ফেরেশতারা, আমি আমার বান্দাকে আমার শৃঙ্খলসমূহের একটি দিয়ে বেঁধেছি, সুতরাং যদি আমি তার জান কবয করি, তবে আমি তাকে ক্ষমা করে দেব, আর যদি আমি তাকে সুস্থ করে দেই, তবে সে এমন অবস্থায় উঠে বসবে যে তার কোন গুনাহ থাকবে না। 33
مَا يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ مِنْ وَصَبٍ وَلَا نَصَبٍ وَلَا هَمٍّ وَلَا حَزَنٍ وَلَا أَذًى وَلَا غَمٍّ حَتَّى الشَّوْكَةُ يُشَاكُهَا إِلَّا كَفَّرَ اللَّهُ مِنْ خَطَايَاهُ رواه مسلم وأحمد وصححه الأرنؤوط
যখনই কোন মুমিন রোগ, ক্লান্তি, আশংকা, দু:খ, ক্ষতি কিংবা মনোকষ্ট - এমনকি কাটার খোঁচা যা তাকে জর্জরিত করে – এর কোনটির দ্বারা আক্রান্ত হয় তখনই আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে থাকেন। 34
ঙ) বিপদে পড়ে বহু মানুষ গাফেল অবস্থা থেকে আল্লাহর স্মরণে ফিরে আসে, ইসলামে ফিরে আসে – তাই একে তাৎক্ষণিকভাবে মন্দ মনে হলেও পরিণতিতে তা উত্তম হিসেবে বিবেচিত হয়।
চ) বিপদাপদের দ্বারা মুমিন বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি হয় ও আখিরাতে তারা অধিক পুরস্কারের যোগ্য হয়। পূর্ববর্তী মনীষীরা বলতেন: “দুনিয়ার বিপদাপদ যদি না-ই থাকত, তবে কিয়ামতের উত্থান হত দেউলিয়া অবস্থায়!”
সুতরাং “আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন”:
সকল অবস্থায়, সকল পরিস্থিতিতে ও সকল কারণে সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া শুধুমাত্র সেই আল্লাহ তাআলার জন্য নির্ধারিত যিনি সকল সৃষ্টির স্রষ্টা ও প্রতিপালনকারী। তিনি যেমন সুখ-শান্তি-কল্যাণের জন্য প্রশংসিত, তেমনি তিনি মন্দের অস্তিত্বের কারণেও প্রশংসার যোগ্য – কেননা এর সবকিছুই সুপরিকল্পিত ও উপযুক্ত কোন কারণে, অতএব আল্লাহ তাআলার কর্মের কোন কিছুই মন্দ নয়:
وَالشَّرُّ لَيْسَ إِلَيْكَ
অর্থাৎ মন্দ আপনার কর্মের সাপেক্ষে মন্দ হিসেবে বিবেচিত নয়। 35
এজন্যই হাদীসে বর্ণিত:
عن عائشة قالت كان رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا رأى ما يحب قال (الحمد لله الذي بنعمته تتم الصالحات) وإذا رأى ما يكره قال (الحمد لله على كل حال)
আয়শা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এমন কিছু দেখতেন যা তিনি পছন্দ করেন, বলতেন: “আল হামদু লিল্লাহিল্লাযী বিনিমাতিহী তাতিম্মুস সালিহাত” অর্থাৎ “সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর যাঁর অনুগ্রহেই সকল উত্তম বিষয় পরিপূর্ণ হয়।” আর যখন এমন কিছু দেখতেন যা তিনি অপছন্দ করেন, বলতেন: “আল হামদু লিল্লাহি আলা কুল্লি হাল” অর্থাৎ “সকল অবস্থাতেই সকল প্রশংসা আল্লাহর।” 36
হামদের ফযীলত:
আল্লাহ তাআলার হামদ উচ্চারণের বহু ফযীলত ও উপকারিতা রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أفضل الذكر لا إله إلا الله وأفضل الدعاء الحمد لله
সর্বোত্তম যিকির হল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এবং সর্বোত্তম দোয়া “আল হামদু লিল্লাহ”। 37
এখানে ‘আল-হামদু’ লিল্লাহকে সর্বোত্তম দোয়া বলা হয়েছে, কেননা আল্লাহ তাআলার স্তুতি পাঠের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর গুণকীর্তন করার সাথে সাথে তাঁর অবিরত অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টির আশা করে। সুতরাং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাঝে ভবিষ্যতে তাঁর পক্ষ থেকে নিত্যনতুন অনুগ্রহ লাভ এবং বিদ্যমান নেয়ামতগুলোর স্থায়ীত্ব ও বৃদ্ধির প্রার্থনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, এবং তাঁর প্রশংসা করার মাঝে তাঁর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার অর্জনের আকাংখা অন্তর্নিহিত রয়েছে – আর তাই এটি সর্বোত্তম দোয়া। আর যেহেতু “আল-হামদু লিল্লাহ” বলার মাঝে সকল কারণে সকল শুকরিয়া ও প্রশংসাকে আল্লাহ তাআলার জন্য নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, তাই বলা যায় এটি হল তাঁর প্রশংসার চূড়ান্ত রূপ – এজন্য এটিকে সর্বোত্তম দোয়া বলার মাঝে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই তো অন্য হাদীসে আমরা পাই, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« الطُّهُورُ شَطْرُ الإِيمَانِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلأُ الْمِيزَانَ. وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ تَمْلآنِ - أَوْ تَمْلأُ - مَا بَيْنَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ
পবিত্রতা সালাতের অর্ধেক, আর “আল-হামদু লিল্লাহ” মীযানকে পরিপূর্ণ করে দেয়। আর “সুবহানাল্লাহ” ও “আল-হামদু লিল্লাহ” আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানকে পুর্ণ করে দেয়... 38
আবার কারও মতে “সর্বোত্তম দোয়া আল-হামদু লিল্লাহ” বলতে গোটা সূরা ফাতিহাকেই বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ সূরা আল-ফাতিহাই হল সর্বোত্তম দোয়া। আর এই অর্থটিও যথার্থ, কেননা নি:সন্দেহে সূরা আল-ফাতিহা মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাওয়াগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে – আর সম্ভবত: এ কারণেই সালাতের প্রত্যেক রাকাতে সূরা আল ফাতিহার পাঠকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে – আর তাই এই সূরাকে সর্বোত্তম দোয়া হিসেবে আখ্যায়িত করা যথার্থ, যা পরবর্তী আলোচনায় আমাদের নিকট ক্রমশ: স্পষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ।
এই হামদের বহু উপকারিতা রয়েছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَمَا إِنَّ رَبَّكَ عَزَّ وَجَلَّ يُحِبُّ الْحَمْدَ
নিশ্চয়ই তোমার রব আযযা ও জাল্লা [অর্থাৎ যিনি সম্মানিত ও মহান] হামদ ভালবাসেন। 39
( ما أنعم الله على عبد نعمة فقال الحمد لله إلا كان الذي أعطاه أفضل مما أخذ )
আল্লাহ কোন বান্দাকে কোন নেয়ামত দান করলে সে যদি “আল-হামদু লিল্লাহ” বলে, তবে অবশ্যই সে যা দিল, তা সে যা নিয়েছে তা অপেক্ষা উত্তম। 40
অর্থাৎ তার হামদ পাঠের উপকারিতা প্রাপ্ত নেয়ামতের উপকারিতার চেয়েও বেশি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
« إِنَّ اللَّهَ لَيَرْضَى عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَأْكُلَ الأَكْلَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا أَوْ يَشْرَبَ الشَّرْبَةَ فَيَحْمَدَهُ عَلَيْهَا »
নিশ্চয়ই আল্লাহ এটা পছন্দ করেন যে বান্দা কোন খাবার খেয়ে এর কারণে তাঁর প্রশংসা করে কিংবা কোন পানীয় পান করে এর কারণে তাঁর প্রশংসা করে। 41
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
كَلِمَتَانِ خَفِيفَتَانِ عَلَى اللِّسَانِ ثَقِيلَتَانِ فِي الْمِيزَانِ حَبِيبَتَانِ إِلَى الرَّحْمَنِ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ سُبْحَانَ اللَّهِ الْعَظِيمِ
দুটি বাক্য, যা জিহ্বায় হালকা কিন্তু পাল্লায় ভারী, পরম করুণাময়ের নিকট প্রিয়, তা হল: “সুবহানাল্লাহি ওয়া বি হামদিহী, সুবহানাল্লাহিল আযীম।” অর্থাৎ আমি যথোপযুক্তভাবে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, এবং তাঁর হামদ সহকারে, আমি যথোপযুক্তভাবে সবচাইতে মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি। 42
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
مَنْ قَالَ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ حُطَّتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ
যে দিনে একশতবার “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী” অর্থাৎ “আমি যথোপযুক্তভাবে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি, এবং তাঁর হামদ সহকারে” পাঠ করবে, তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে, যদিও বা তা সাগরের ফেনারাশির অনুরূপও হয়। 43
عَنْ جُوَيْرِيَةَ أَنَّ النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا بُكْرَةً حِينَ صَلَّى الصُّبْحَ وَهِىَ فِى مَسْجِدِهَا ثُمَّ رَجَعَ بَعْدَ أَنْ أَضْحَى وَهِىَ جَالِسَةٌ فَقَالَ « مَا زِلْتِ عَلَى الْحَالِ الَّتِى فَارَقْتُكِ عَلَيْهَا ». قَالَتْ نَعَمْ. قَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- « لَقَدْ قُلْتُ بَعْدَكِ أَرْبَعَ كَلِمَاتٍ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ لَوْ وُزِنَتْ بِمَا قُلْتِ مُنْذُ الْيَوْمِ لَوَزَنَتْهُنَّ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ عَدَدَ خَلْقِهِ وَرِضَا نَفْسِهِ وَزِنَةَ عَرْشِهِ وَمِدَادَ كَلِمَاتِهِ »
উম্মুল মুমিনীন জুওয়ায়রিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদিন ফজরের সালাত আদায় শেষে ভোরে তাঁকে তাঁর সালাতের স্থানে রেখে বের হলেন, অত:পর সকাল হলে [অর্থাৎ সূর্য ওঠার পর দিবসের খানিকটা অতিক্রান্ত হলে] ফিরে এসে তাঁকে বসা অবস্থাতেই পেলেন ও বললেন: “তুমি কি সেভাবেই ছিলে যেভাবে আমি তোমাকে রেখে গিয়েছি?” তিনি বললেন: “হাঁ।” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “আমি তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর চারটি বাক্য তিনবার বলেছি, যদি তা সকাল থেকে ইতোমধ্যে তোমার পঠিত [সকল যিকরের] সাথে ওজন করা হয়, তবে তা ওজনে বেশি হবে: “সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, আদাদা খালকিহী ওয়া রিদা নাফসিহী ওয়া যিনাতা আরশিহী ওয়া মিদাদা কালিমাতিহী।” অর্থাৎ “আমি আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা বর্ণনা করছি যথোপযুক্ত পন্থায় ও তাঁর হামদ সহকারে – তাঁর সৃষ্টির সংখ্যার অনুরূপ, তাঁর নফসের সন্তুষ্টির সমপরিমাণ, তাঁর আরশের ওজনের সমান ও তাঁর বাণীর সংখ্যার অনুরূপ [অর্থাৎ অসীম] [পবিত্রতা ঘোষণা করছি]।” 44
এমনিভাবে হামদের ফযীলত ও উপকারিতা সংক্রান্ত বহু বর্ণনা রয়েছে যার কিয়দংশ এখানে উল্লেখ করা হল।
রাব্বুল আলামীন:
সূরা আল ফাতিহার প্রথম আয়াতে আল্লাহ তাআলার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে রাব্বুল আলামীন তথা সৃষ্টির রব হিসেবে।
‘আলামীন’ ‘আলাম’ এর বহুবচন [বাক্যে শব্দের অবস্থানগত ব্যাকরণ অনুযায়ী তা ‘আলামূন’ বা ‘আলামীন’ হিসেবে আসে]। আলাম অর্থ জগৎ - এটি সামষ্টিক একটি শব্দ এবং আরবীতে এর একবচন হয় না। মানুষের জগৎ, জ্বিনদের জগৎ, প্রাণীজগৎ, উদ্ভিদ জগৎ প্রভৃতি প্রত্যেকটি একেকটি আলাম বা জগৎ। সুতরাং আয়াতের অর্থ এই যে এই সকল জগতকে এগুলোর প্রকৃতি ও প্রয়োজনের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এক আল্লাহ তাআলাই প্রতিপালন করছেন! এতে আমরা হামদের একটা কারণ খুঁজে পাই। সমস্ত প্রশংসা ও শুকরিয়া এক আল্লাহর জন্য নির্ধারিত, কেননা তিনি সকল সৃষ্টিকে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজনের ভিন্নতা সত্ত্বেও প্রতিপালন করছেন। সকলকে তিনি সৃষ্টি করেছেন ও সকলকে তিনি রিযিক দিচ্ছেন প্রয়োজন মোতাবেক:
وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا
আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহরই। 45
রব শব্দের মধ্যে অনেকগুলো অর্থ নিহিত আছে। আল্লাহ তাআলা ‘আর-রব্ব’ – অর্থাৎ তিনি স্রষ্টা, সৃষ্টির করার পর সৃষ্ট বস্তুর প্রয়োজন পূরণকারী ও প্রতিপালনকারী, তাদেরকে রিযিকদাতা, তাদের সকল বিষয় পরিচালনাকারী, তাদেরকে তারবিয়াহ দানকারী মুরব্বী, তিনিই মালিক, প্রভু ও একমাত্র মাবুদ যার আনুগত্য করা হয় – এই সকল অর্থ নিহিত আছে রব শব্দের মাঝে।
আমরা যদি রব শব্দের এই অর্থ মনে গেঁথে নেই আর প্রত্যেকবার “আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” বাক্যটি পাঠ করার সময় এর ধ্যান অন্তরে রাখি, তবে আমরা অন্তরের পরিবর্তন উপলব্ধি করব ইনশাআল্লাহ!
আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টিকে লালন করছেন তাদেরকে রিযিক দেয়ার মাধ্যমে, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তাদের কল্যাণের দিকে তাদেরকে দিকনির্দেশনা দেয়ার মাধ্যমে। প্রাণীজগতের যে কোন প্রাণীর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে জন্ম থেকেই তার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় প্রবৃত্তিগুলো তার মধ্যে দিয়ে দেয়া আছে! এমনকি মায়ের বুক থেকে কিভাবে দুধ টেনে নিতে হবে – তা তাকে ইতোমধ্যেই শিখিয়ে দেয়া হয়েছে – পৃথিবীর সকল জ্ঞানীজনেরা একত্র হয়েও এই শিশুটিকে তা শেখাতে পারত না! আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন!
এ সবই হল সাধারণ প্রতিপালন – যা সকল সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য – কেননা আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবে সকলের রব – সে মানুষ হোক বা পশু, বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী।
কিন্তু আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ ‘তারবিয়া’ বা প্রতিপালন আছে যা কেবল তার ঈমানদার বান্দাদের জন্য প্রযোজ্য। তিনি তাঁর মুত্তাকী ও নেককার ওলীদেরকে বিশেষভাবে প্রতিপালন করেন তাদেরকে সত্যের দিকে পথ দেখানোর মাধ্যমে, তাদেরকে নেক আমলের তাওফীক দান করার মাধ্যমে এবং তাদের ও তাঁর মাঝে বিদ্যমান সকল বাধা দূর করার মাধ্যমে:
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ ۗ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
আল্লাহ ঈমানদারদের অভিভাবক, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন৷ আর যারা কুফরী করে, তাদের অভিভাবক হল তাগূত৷ তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারে নিয়ে যায়৷ তারা আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে৷ 46
আর সম্ভবত তারবিয়া বা প্রতিপালনের এই বিশেষ অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখেই নবী-রাসূলগণের দোয়াগুলো ছিল আল্লাহ তাআলাকে ‘রব’ নামে ডেকে, কেননা তাঁদের প্রার্থনাগুলো সাধারণ মানুষের মত নিছক পার্থিব চাওয়া নয়, বরং তাঁদের সমস্ত চাওয়াই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও আখিরাতের কল্যাণ কামনার সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম এঁর দোয়া:
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
তারা দুজনে বললেন: “হে আমাদের রব, আমরা নিজদের উপর যুল্‌ম করেছি। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন আর আমাদেরকে রহম না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব। 47
আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম এখানে আল্লাহকে রব নামে ডেকে তাঁর নিকট ক্ষমা ও দয়ার প্রার্থনা করেছেন – যা তাদের আত্মশুদ্ধির জন্য প্রয়োজন, আর নি:সন্দেহে আল্লাহ কর্তৃক কাউকে তাঁর রহমতের আবরণে আবৃত করে তাকে ক্ষমা করা ও সংশোধিত হওয়ার সুযোগ দেয়া বিশেষ প্রতিপালনের অন্তর্ভুক্ত – অর্থাৎ সেই প্রতিপালন যার দ্বারা আল্লাহ তাঁর মুমিন বান্দাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করেন।
নূহ আলাইহিস সালাম এঁর দোয়া:
وَقَالَ نُوحٌ رَبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا - إِنَّكَ إِنْ تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا - رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَنْ دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا تَبَارًا
আর নূহ বলল, “হে আমার রব! যমীনের উপর কোন কাফিরকে অবশিষ্ট রাখবেন না। আপনি যদি তাদেরকে অবশিষ্ট রাখেন তবে তারা আপনার বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করবে এবং দুরাচারী ও কাফির ছাড়া অন্য কারো জন্ম দেবে না। হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, আর যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না।” 48
এই দোয়ায় নূহ আলাইহিস সালাম সে সমস্ত অবিশ্বাসীদের ধ্বংস কামনা করেছেন, যাদেরকে তিনি দীর্ঘকাল সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা জেনে বুঝে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সত্যের অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা পোষণ করেছে। সেই সাথে তিনি মুমিনদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেছেন। এ দোয়ায় অবিশ্বাসীদের ধ্বংস ও মুমিনদের মাগফিরাত কামনা ঈমানদারগণের আখিরাতের কল্যাণের সাথে সংশ্লিষ্ট, অতএব তা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে প্রতিপালিত হওয়া তথা তাঁর বিশেষ তারবিয়ার সাথে সম্পর্কিত – এজন্য তা রব নাম ধরে তাঁকে ডেকে শুরু হয়েছে।
ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এঁর দোয়া:
وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ - رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا ۖ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ - رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ ۚ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কাবার ভিত্‌গুলো উঠাচ্ছিল [এবং বলছিল,] “হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। হে আমাদের রব, আমাদেরকে আপনার অনুগত করুন এবং আমাদের বংশধরের মধ্য থেকে আপনার অনুগত কওম বানান। আর আমাদেরকে আমাদের ইবাদতের বিধি-বিধান দেখিয়ে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের রব, তাদের মধ্যে তাদের থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের প্রতি আপনার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবে আর তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবে। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান।” 49
এই দোয়ায় ইব্রাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমাস সালাম যা চেয়েছেন, তা হল:
এক. আল্লাহ যেন তাঁদের নেক আমল ও দোয়াকে কবুল করেন।
দুই. তিনি যেন তাঁদেরকে ও তাঁদের বংশধরদেরকে তাঁর অনুগত বান্দায় পরিণত করেন।
তিন. তিনি যেন তাঁদেরকে ও তাঁদের বংশধরদেরকে ইবাদতের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেন।
চার. তিনি যেন তাঁদেরকে ও তাঁদের বংশধরদেরকে ক্ষমা করেন।
পাঁচ. তিনি যেন তাঁদের বংশধরদের হেদায়েত ও আত্মশুদ্ধির জন্য তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূলকে প্রেরণ করেন, যিনি তাদেরকে কিতাব ও হিকমত তথা কিতাব ও সুন্নাত শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে পরকালীন কল্যাণের পথে তাদেরকে গঠন করবেন।
লক্ষ্যণীয় যে এ সবগুলোই আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে প্রতিপালিত হতে চাওয়া, তথা আল্লাহ তাআলার বিশেষ তারবিয়া কামনার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রার্থনা, আর তা শুরু হয়েছে আল্লাহকে রব নাম ধরে ডেকে।
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَٰذَا الْبَلَدَ آمِنًا وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ - رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ ۖ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي ۖ وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ - رَبَّنَا إِنِّي أَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِي بِوَادٍ غَيْرِ ذِي زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ رَبَّنَا لِيُقِيمُوا الصَّلَاةَ فَاجْعَلْ أَفْئِدَةً مِنَ النَّاسِ تَهْوِي إِلَيْهِمْ وَارْزُقْهُمْ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُونَ - رَبَّنَا إِنَّكَ تَعْلَمُ مَا نُخْفِي وَمَا نُعْلِنُ ۗ وَمَا يَخْفَىٰ عَلَى اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ - الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ ۚ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ - رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي ۚ رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ - رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ
আর স্মরণ কর যখন ইবরাহীম বলল, “হে আমার রব, আপনি এ শহরকে নিরাপদ করে দিন এবং আমাকে ও আমার সন্তানদেরকে মূর্তি পূজা থেকে দূরে রাখুন। হে আমার রব, নিশ্চয় এসব মূর্তি অনেক মানুষকে পথভ্রষ্ট করেছে, সুতরাং যে আমার অনুসরণ করেছে, নিশ্চয় সে আমার দলভুক্ত, আর যে আমার অবাধ্য হয়েছে, তবে নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমি আমার কিছু বংশধরকে ফসলহীন উপত্যকায় আপনার পবিত্র ঘরের নিকট বসতি স্থাপন করালাম, হে আমাদের রব, যাতে তারা সালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের হৃদয় আপনি তাদের দিকে ঝুঁকিয়ে দিন এবং তাদেরকে রিযিক প্রদান করুন ফল-ফলাদি থেকে যেন তারা শুকরিয়া আদায় করে। হে আমাদের রব, নিশ্চয় যা আমরা গোপন করি ও যা প্রকাশ করি তা আপনি জানেন, আর কোন কিছুই আল্লাহর নিকট গোপন নেই, না যমীনে না আসমানে। সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি বৃদ্ধ বয়সে আমাকে ঈসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দোয়া শ্রবণকারী। হে আমার রব, আমাকে সালাত কায়েমকারী বানান এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও, হে আমাদের রব, আর আমার দোয়া কবুল করুন। হে আমাদের রব, যেদিন হিসাব কায়েম হবে, সেদিন আপনি আমাকে, আমার পিতামাতাকে ও মুমিনদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।” 50
এখানে যে দোয়াগুলো রয়েছে তা হল:
এক. মক্কাকে নিরাপদ নগরীতে পরিণত করার দোয়া, যার ফলে বিশ্বের মানুষ নিরাপদে এই নগরীতে করণীয় ইবাদত তথা হজ্জ্ব ও উমরা পালনে সক্ষম হবে।
দুই. উম্মাতকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখার দোয়া।
তিন. তাঁর বংশধরেরা যেন সালাত কায়েম করে – সে দোয়া।
চার. তাঁর বংশধরেরা যেন মানুষের ভালবাসা লাভ করে ও ফলফলাদি থেকে রিযিক লাভ করে, যার ফলশ্রুতিতে তারা শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে এর কল্যাণকে আখিরাতের কল্যাণে রূপান্তরিত করবে – সেই দোয়া। এখানে শুকরিয়া আদায়ের মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে তাঁরই ইবাদতে ব্যবহার করা – আর তাই এটিও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সাথে সংশ্লিষ্ট।
পাঁচ. দোয়া কবুল ও মুমিনদের জন্য ক্ষমার প্রার্থনা।
পূর্বের দোয়াগুলোর মতই এ সকল প্রার্থনাও আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে বেড়ে ওঠার সাথে সংশ্লিষ্ট, সুতরাং তা আল্লাহ তাআলার বিশেষ তারবিয়া বা প্রতিপালনের আওতাভুক্ত হতে চাওয়ার আকাংখা, এবং যথারীতি তা আল্লাহ তাআলাকে রব নামে ডেকে শুরু হয়েছে।
মুসা আলাইহিস সালাম এঁর দোয়া
قَالَ رَبِّ اشْرَحْ لِي صَدْرِي - وَيَسِّرْ لِي أَمْرِي - وَاحْلُلْ عُقْدَةً مِنْ لِسَانِي - يَفْقَهُوا قَوْلِي - وَاجْعَلْ لِي وَزِيرًا مِنْ أَهْلِي - هَارُونَ أَخِي - اشْدُدْ بِهِ أَزْرِي - وَأَشْرِكْهُ فِي أَمْرِي - كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيرًا - وَنَذْكُرَكَ كَثِيرًا - إِنَّكَ كُنْتَ بِنَا بَصِيرًا
সে বলল, “হে আমার রব, আমার বুক প্রশস্ত করে দিন, এবং আমার কাজ সহজ করে দিন, আর আমার জিহ্বার জড়তা দূর করে দিন - যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আর আমার পরিবার থেকে আমার জন্য একজন সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দিন। আমার ভাই হারূনকে। তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার কাজে শরীক করুন। যাতে আমরা বেশি করে আপনার তাসবীহ পাঠ করতে পারি এবং অধিক পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি। আপনিই তো আমাদের সম্যক দ্রষ্টা।” 51
এখানে মুসা আলাইহিস সালাম যা চেয়েছেন তা মূলত ফিরআউন ও তার জাতিকে সত্যের পথে দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা – আর যেহেতু নবী-রাসূলগণের মূল কাজ আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছানো – তাই এ কাজে আল্লাহর সাহায্য কামনা প্রকৃতপক্ষে তাঁর সন্তুষ্টির পথে প্রতিপালিত হতে চাওয়ারই প্রার্থনা – আর যথারীতি তা শুরু হয়েছে রব নামে তাঁকে ডেকে।
ইউসুফ আলাইহিস সালাম এঁর দোয়া:
رَبِّ قَدْ آتَيْتَنِي مِنَ الْمُلْكِ وَعَلَّمْتَنِي مِنْ تَأْوِيلِ الْأَحَادِيثِ ۚ فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۖ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ
হে আমার রব, আপনি আমাকে রাজত্ব দান করেছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিখিয়েছেন। হে আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা, দুনিয়া ও আখিরাতে আপনিই আমার অভিভাবক, আমাকে মুসলিম অবস্থায় মৃত্যু দিন এবং নেককারদের সাথে আমাকে যুক্ত করুন।52
এই দোয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
নবী যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এঁর দোয়া:
كهيعص - ذِكْرُ رَحْمَتِ رَبِّكَ عَبْدَهُ زَكَرِيَّا - إِذْ نَادَىٰ رَبَّهُ نِدَاءً خَفِيًّا - قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا - وَإِنِّي خِفْتُ الْمَوَالِيَ مِنْ وَرَائِي وَكَانَتِ امْرَأَتِي عَاقِرًا فَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ وَلِيًّا - يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنْ آلِ يَعْقُوبَ ۖ وَاجْعَلْهُ رَبِّ رَضِيًّا
কাফ-হা-ইয়া-‘আঈন-সোয়াদ। এটি তোমার রবের রহমতের বিবরণ তাঁর বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন সে তার রবকে একান্তে ডেকেছিল। সে বলেছিল, “হে আমার রব! আমার হাড়গুলো দুর্বল হয়ে গিয়েছে এবং বার্ধক্যবশতঃ আমার মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছে। হে আমার রব, আপনার নিকট দোয়া করে আমি কখনো ব্যর্থ হইনি। আর আমার পরে স্বগোত্রীয়দের সম্পর্কে আমি আশংকাবোধ করছি। আমার স্ত্রী তো বন্ধ্যা, অতএব আপনি আমাকে আপনার পক্ষ থেকে একজন উত্তরাধিকারী দান করুন। যে আমার উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকূবের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। হে আমার রব, আপনি তাকে পছন্দনীয় বানিয়ে দিন। 53
আপাতদৃষ্টিতে এই দোয়াটিকে নিছক দুনিয়াবী প্রার্থনা – তথা সন্তানলাভের প্রার্থনা বলে মনে হলেও লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম এখানে শুধুমাত্র পিতৃত্বের আশায় এই দোয়া করেননি, বরং এর পেছনে তাঁর রয়েছে এক বৃহত্তর উদ্দেশ্য – আর তা হল নবুওয়্যতের জ্ঞানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এখানে লক্ষ্যণীয় যে যাকারিয়া আলাইহিস সালাম যে উত্তরাধিকারের কথা বলছেন, তা সম্পত্তির উত্তরাধিকার নয় বরং জ্ঞানের উত্তরাধিকার। আর এজন্যই তিনি “ইয়াকূবের বংশের উত্তরাধিকার” কথাটি উল্লেখ করেছেন, অথচ নবী ইয়াকূবের সাথে তাঁর সময়ের বিশাল ব্যবধান। আর তাই তিনি যে আশংকার কথা এই দোয়াতে উল্লেখ করেছেন তা হল তাঁর মৃত্যুর পর বনু-ইসরাঈলের মাঝে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা, আর তিনি সন্তান কামনা করেছেন এজন্যই যেন তাঁর পরেও তাঁর বংশধরেরা দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজকে অব্যাহত রাখে। সুতরাং এখানে তাঁর সন্তানলাভের প্রার্থনার সাথে আখিরাতের কল্যাণের সংশ্লিষ্টতা সুস্পষ্ট।
তেমনি ঈসা আলাইহিস সালাম এঁর দোয়া
قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا أَنْزِلْ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ تَكُونُ لَنَا عِيدًا لِأَوَّلِنَا وَآخِرِنَا وَآيَةً مِنْكَ ۖ وَارْزُقْنَا وَأَنْتَ خَيْرُ الرَّازِقِينَ
মারইয়ামের পুত্র ঈসা বলল, “হে আল্লাহ, হে আমাদের রব, আসমান থেকে আমাদের প্রতি খাবারপূর্ণ দস্তরখান নাযিল করুন; এটি আমাদের জন্য ঈদ হবে। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য। আর আপনার পক্ষ থেকে এক নিদর্শন হবে। আর আমাদেরকে রিযিক দান করুন, আপনিই শ্রেষ্ঠ রিযিকদাতা।” 54
এখানে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এক নিদর্শন চেয়েছেন যা তাঁর অনুসারীদের ঈমানকে দৃঢ় করবে।
তেমনি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এঁর প্রতি আল্লাহ পাকের নির্দেশ:
وَقُلْ رَبِّ أَدْخِلْنِي مُدْخَلَ صِدْقٍ وَأَخْرِجْنِي مُخْرَجَ صِدْقٍ وَاجْعَلْ لِي مِنْ لَدُنْكَ سُلْطَانًا نَصِيرًا
আর বলুন [হে নবী!], “হে আমার রব, আমাকে প্রবেশ করান উত্তমভাবে এবং বের করুন উত্তমভাবে। আর আপনার পক্ষ থেকে আমাকে সাহায্যকারী শক্তি দান করুন।” 55
এই দোয়ায় আল্লাহর রাসূল সত্যের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়েছেন – যেন সত্য দ্বীন বিজয় লাভ করে – যা বান্দাদের আখিরাতের কল্যাণের সাথে সংশ্লিষ্ট। তেমনি আল্লাহ তাআলার বাণী:
وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا
আর তুমি বল, “হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।” 56
এই দোয়ায় রয়েছে দ্বীনের জ্ঞানের বৃদ্ধির প্রার্থনা, যা আখিরাতের কল্যাণ তথা আল্লাহ তাআলার বিশেষ তারবিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট।
সুতরাং নবী-রাসূলদের এই দোয়াগুলো লক্ষ্য করলে আমরা দেখব যে তাঁদের সকল চাওয়া আখিরাতের কল্যাণের সাথে সংশ্লিষ্ট।এমনকি তাঁরা দুনিয়ার কোন বস্তুও এজন্যই চাইতেন যে তা আখিরাতে সাফল্যের মাধ্যম হবে। আর তাই এ সমস্ত চাওয়াই মূলত আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে প্রতিপালিত হওয়ার প্রার্থনা – যা আল্লাহ তাআলার বিশেষ প্রতিপালন – যা তিনি তাঁর ওলী, মুমিন মুত্তাকী বান্দাদেরকে দান করেন – আর সম্ভবত: এজন্যই এগুলো শুরু হয়েছে আল্লাহ তাআলাকে ‘রব’ নাম ধরে ডেকে, কেননা তিনি তাঁদেরকে হেদায়েতের ওপর গঠনকারী। আর আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
“আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” এর দ্বারা আত্মশুদ্ধি
এবারে দেখা যাক অর্থ ও ব্যাখ্যার প্রতি মনোযোগ রেখে “আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” আয়াতটি পাঠ আত্মশুদ্ধিতে কী ধরনের ভূমিকা রাখে। বিষয়টি নিচের চারটি পয়েন্টে তুলে ধরা হল:
এক. “আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” অন্তরে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, ভালবাসা ও ভক্তির জন্ম দেয় – যা কিনা অন্তরের কাম্য বৈশিষ্ট্য – যা ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। অর্থাৎ অন্তরে এ সকল অনুভূতি থাকা ঈমানের দাবী। আর অন্তরে এ সকল অনুভূতি নিয়ে বান্দা যখন তার রবের ইবাদত করে, তখন সে ইবাদত হয় প্রাণবন্ত, সুন্দর। এ ধরনের প্রাণবন্ত ইবাদত একদিকে ঈমনকে চাঙ্গা করে, অপরদিকে তা ইবাদতের সওয়াবকে বাড়িয়ে দেয়।
দুই. এই বাক্যের মাধ্যমে সকল প্রশংসা ও শুকরিয়া আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করার ফলে বান্দার মনে জন্ম নেয় বিনয় ও ক্ষুদ্রতাবোধ। তেমনি আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নেয়ামতের স্মরণের সাথে সাথেই তার অন্তরে তৈরী হয় রবের ইবাদত ও আনুগত্যে নিজ ঘাটতি ও অবহেলার স্মরণে সৃষ্ট অপরাধবোধ। সুতরাং “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” বলার মাঝে আল্লাহ তাআলার পূর্ণতা, মর্যাদা ও ইহসানের স্বীকৃতির সাথে সাথেই রয়েছে নিজদের দুর্বলতা, অযোগ্যতা, অক্ষমতা, ত্রুটি ও আল্লাহর প্রতি সার্বক্ষণিক মুখাপেক্ষিতার স্বীকৃতি - আর এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য যা ইবাদতের মধ্যে থাকা চাই। যদি বান্দা নিজের আমলের ব্যাপারে গৌরবের মনোভাব নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে, তবে তা আল্লাহর নিকট কবুল হয় না, কেননা এ ধরনের আত্মম্ভরিতা নিজের অক্ষমতা ও নতির স্বীকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক, ফলে তা ইবাদতের অর্থ ও তাৎপর্যের বিপরীত। অপরপক্ষে বান্দা যখন ক্ষুদ্রতাবোধ ও নতিস্বীকারের মানসিকতা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করে, তখন সে সহজে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে পারে। বাস্তবিকপক্ষেই আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার সবচেয়ে প্রশস্ত দরজা হল নতিস্বীকার ও ক্ষুদ্রতাবোধের দরজা, কেননা আল্লাহর জন্য বিনয়ী ও নত হওয়াই হল ইবাদতের সারবস্তু।
তিন. “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” পাঠের মাঝে একদিকে যেমন অন্তরকে ইবাদতের পূর্বে ইবাদতের প্রেরণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুভূতি যেমন: আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও নিজের ক্ষুদ্রতার অনুভূতিতে পূর্ণ করা হয়, তেমনি এই বাক্য পাঠে ইবাদত সুসম্পন্ন হওয়ার পর অন্তরকে আমল বিনষ্টকারী অনুভূতি তথা অহংকার, রিয়া, উজব তথা নিজের আমলের দ্বারা চমৎকৃত হওয়া – ইত্যাদি থেকে মুক্ত করা হয়। অর্থাৎ এই বাক্যটি একই সাথে ইবাদতের শুরুতে ও শেষে অন্তরের সঠিক অবস্থা বিদ্যমান রাখার জন্য অদ্বিতীয় এক মহৌষধ।
চার. উপলব্ধি সহকারে “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” পাঠের মাঝে রয়েছে অন্তরের এক ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্তির পথ – আর তা হল আল্লাহ সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা। অজ্ঞতাবশত অনেকেই মহান আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে বিভিন্ন কুধারণা পোষণ করে থাকে। অনেকের মনেই আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত শরীয়তের বিধিবিধানের ব্যাপারে আপত্তি আছে, কারও মনে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত আপাতদৃষ্টিতে অপ্রিয় ও মন্দ বিভিন্ন ঘটনাবলীর ব্যাপারে রয়েছে ক্ষোভ – আর এই আপত্তি বা ক্ষোভের কারণ আল্লাহ তাআলার কর্মের পরিপূর্ণতা ও প্রতিটি ঘটনার পেছনে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের বিদ্যমানতা উপলব্ধি করতে না পারা। তাই বান্দা যখন “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” পাঠে উপলব্ধি করে যে সকল ঘটনার কারণেই আল্লাহ তাআলা প্রশংসার যোগ্য, তখন সে জানে যে অনর্থক ও বিনা কারণে কোন কষ্টকর কিছু সৃষ্টি করা তাঁর স্তুতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, অর্থাৎ এটি সম্ভব নয় যে সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান ও পরম করুণাময় স্রষ্টা পৃথিবীতে সামান্যতম কষ্টের অস্তিত্বও অনুমোদন করবেন কোন কারণ বা তাৎপর্য ছাড়াই। এটি সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হত, তবে সকল প্রশংসা তাঁর জন্য নির্ধারিত হত না, তেমনি তিনি সকল ঘটনার কারণে প্রশংসার যোগ্য হতেন না। অতএব প্রতিটি ঘটনার কারণে তাঁর প্রশংসিত হওয়ার এই সংবাদ বান্দার মনে সংশয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তা ও কুধারণা দূর করে এতে তার রবের প্রতি আস্থা, নির্ভরতা, নিরাপত্তাবোধ, আশাবাদ ও সুধারণার জন্ম দেয় – কেননা সে জানে যে তাকে তিনি যে আদেশই করেন, কিংবা যে বিপদই তার জন্য নির্ধারন করেন – সেটি তার ধারণক্ষমতার মধ্যে এবং সেটি পরিণতিতে তার জন্য কল্যাণকর, যদি সে আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করে ও খুশিমনে তা মেনে নেয় ও সঠিক আচরণ করে – যেমনিভাবে অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসাকালীন ব্যাথা-বেদনার জন্য চিকিৎসককে গালমন্দ করে না, বরং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে, কেননা সে জানে যে চিকিৎসকের এই কাজটি তার জন্য পরিণতিতে কল্যাণকর। পৃথিবীতে বিদ্যমান আপাতদৃষ্টিতে মন্দ যে কোন বিষয়ের জন্যই এ কথা প্রযোজ্য। সুতরাং “সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য নির্ধারিত” – এ বাক্যটি বলামাত্র বান্দা জানে যে প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে আল্লাহ তাআলার অগাধ জ্ঞান, বিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, সুন্দর উদ্দেশ্য ও অপার দয়া – আপাতদৃষ্টিতে একে যতই কষ্টকর, নৃশংস বা নির্মম বলে মনে হোক না কেন। এমনিভাবে এই বাক্য বান্দার মনের সমস্ত কুধারণা, সংশয় ও সন্দেহ দূর করে তার রব সম্পর্কে তার অন্তরে সুধারণা, সুদৃঢ় বিশ্বাস ও অবিচল আস্থার জন্ম দেয়।
আল্লাহ আমাদেরকে সালাতে ধ্যানের সাথে “আল-হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” বাক্যটি পাঠ করার মাধ্যমে আমাদের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার তাওফীক দান করুন।

এই লেকচারের আলোকে নিজেকে যাচাই করুন
1) কোন দু’টি বাক্য জিহ্বায় হালকা কিন্তু পাল্লায় ভারী, পরম করুণাময়ের নিকট প্রিয়?

2) অনাবৃষ্টির কারণ হচ্ছে-

3) নিচের কোনটি সর্বোত্তম যিকর?

4) যে আল্লাহর আনুগত্যের পথ বেছে নেয়, তার দুনিয়ার জীবন-

5) মুমিন অবস্থায় উত্তম আমল করার দুটি প্রতিদান হলো-

6) নিত্যনতুন রোগ-ব্যধি ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে-

7) সর্বোত্তম দু’আ কোনটি?

8) আল্লাহ তাআলা কার কাজগুলোকে সুবিন্যস্ত করে দেন?

9) আল্লাহ তাআলা জীবন ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন কেন?

10) অপছন্দনীয় কোন কিছু দেখলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলতেন?


কুইজের ফলাফল দেখতে নিচের “কুইজের ফলাফল দেখুন” বাটনে ক্লিক করুন!


নাম


ই-মেইল


ফোন/মোবাইল


  1. তিরমিযী(৩৩৩৪)।
  2. সূরা আল-মুতাফফিফীন, ৮৩ : ১৪।
  3. সূরা আয-যুখরুফ, ৪৩: ৭১।
  4. সূরা কাফ, ৫০ : ৩৫।
  5. সূরা আল-ফুরকান, ২৫: ১৬।
  6. সূরা আল-কাহফ, ১৮ : ১০৮।
  7. সূরা আল-বাকারা, ২: ২৮৬
  8. সূরা আত-তালাক, ৬৫: ৭।
  9. সূরা আল-বাকারা, ২: ১৮৫
  10. সূরা আল-মায়িদা, ৫: ৬
  11. সূরা হাজ্জ, ২২: ৭৮
  12. মুসলিম(২৫৭৭)।
  13. আহমদ(১৫৯৬৭) প্রমুখ।
  14. সূরা আল-লাইল, ৯২ : ৫-৭
  15. সূরা আল-বাকারা, ২: ২৯
  16. সূরা আল-আরাফ, ৭: ৩১
  17. সূরা আন-নিসা, ৪: ৩
  18. সূরা আন-নাহল, ১৬ : ৯৭
  19. তিরমিযী(২৪৬৫) প্রমুখ।
  20. সূরা আত-তালাক,৬৫: ২-৩।
  21. সূরা আত-তালাক,৬৫: ৪।
  22. সূরা আর-রূম, ৩০: ৪৭।
  23. সূরা আত-তালাক, ৬৫: ২।
  24. সূরা আর-রহমান, ৫৫: ১৩
  25. সূরা আর-রূম, ৩০: ২১
  26. মুসলিম(৯১)।
  27. মুসলিম(১৭৯)।
  28. সূরা মূলক, ৬৭: ২।
  29. সূরা আর-রুম, ৩০: ৪১।
  30. সূরা আন-নিসা, ৪ : ৭৯।
  31. মুসলিম(২৫৭২)।
  32. আহমদ(৭৮৪৬), তিরমিযী(২৩৯৯) প্রমুখ।
  33. আল হাকিম(৭৮৭১), আত তাবারানী (আল মুজাম আল কাবীর, ৭৭০১) প্রমুখ।
  34. মুসলিম(২৫৭৩)
  35. মুসলিম(৭৭১)।
  36. ইবনে মাজাহ(৩৮০৩)।
  37. তিরমিযী(৩৩৮৩), ইবনে মাজাহ(৩৮০০) প্রমুখ।
  38. মুসলিম(২২৩)
  39. আহমদ(১৫৬২৪)।
  40. ইবনে মাজাহ(৩৮০৫) প্রমুখ।
  41. মুসলিম(২৭৩৪)।
  42. বুখারী(৬৪০৬), মুসলিম(২৬৯৪)।
  43. বুখারী(৬৪০৫), মুসলিম(২৬৯১, ২৬৯২)।
  44. মুসলিম(২৭২৬)।
  45. সূরা হুদ, ১১ : ৬।
  46. সূরা আল-বাকারা, ২ : ২৫৭।
  47. সূরা আল-আরাফ ৭:২৩।
  48. সূরা নূহ, ৭১: ২৬-২৮।
  49. সূরা আল-বাকারা ২: ১২৭ – ১২৯।
  50. সূরা ইব্রাহীম ১৪:৩৫ – ৪১।
  51. সূরা ত্বহা, ২০:২৫ – ৩৫
  52. সূরা ইউসুফ, ১২: ১০১।
  53. সূরা মারইয়াম, ১৯ : ১-৬।
  54. সূরা আল-মায়িদা ৫: ১১৪।
  55. সূরা আল-ইসরা, ১৭ : ৮০।
  56. সূরা ত্বহা, ২০: ১১৪।

No comments:

Post a Comment