Wednesday 6 January 2016

WAY TO THE JANNAH

COLLECTED FROM OIEP

আল-কুরআনের পরিবার – শান্তির আধার, পৃথিবীর জান্নাত ও আল্লাহর নিকটজন!
পৃথিবীর কণ্টকাকীর্ণ জীবনে শান্তির একমাত্র ঠিকানা আল-কুরআন:
… أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ(২৮)
...জেনে রাখ, আল্লাহর ‘যিকির’ এর দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। 1
একদল মুফাসসিরের মতে এখানে আল্লাহর যিকির দ্বারা উদ্দেশ্য আল-কুরআন।

আল-কুরআনের হিফয, তিলাওয়াত, অর্থ অনুধাবন, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা, এর আমল ও শিক্ষাদান – যদি এগুলো হয় একটি পরিবারের কর্মকাণ্ডের মূল – তবে তা বিশ্বের সবচেয়ে সুখী পরিবার - তারা আল কুরআনের পরিবার:
« يُؤْتَى بِالْقُرْآنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَهْلِهِ الَّذِينَ كَانُوا يَعْمَلُونَ بِهِ تَقْدُمُهُ سُورَةُ الْبَقَرَةِ وَآلُ عِمْرَانَ كَأَنَّهُمَا غَمَامَتَانِ أَوْ ظُلَّتَانِ سَوْدَاوَانِ بَيْنَهُمَا شَرْقٌ أَوْ كَأَنَّهُمَا حِزْقَانِ مِنْ طَيْرٍ صَوَافَّ تُحَاجَّانِ عَنْ صَاحِبِهِمَا »
কেয়ামতের দিন কুরআন ও এর পাঠকারীদের – যারা এর ওপর আমল করেছে – তাদেরকে আনা হবে, এর অগ্রভাগে থাকবে সূরা আল বাকারা ও আলে ইমরান। যেন তা দুটি কালো সামিয়ানা বা মেঘের খণ্ড যার মাঝখানে রয়েছে ঔজ্জ্বল্য, কিংবা তা যেন ডানা মেলে উড়ে চলা পাখির দুটি ঝাঁক, তারা তাদের পাঠকারীদের পক্ষে বিতর্ক করবে। 2
আল-কুরআনের যে সকল পাঠকারী এর শিক্ষা অনুযায়ী আমল করে, তাদেরকে এখানে এমন দুটি শব্দ দ্বারা আখ্যায়িত করা হয়েছে যা মানুষের সবচেয়ে আপনজনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়: ১) ‘আহল’ – পরিবার ও ২) ‘সাহিব’ – সাথী।
আল-কুরআনের সান্নিধ্যে জীবন কতই না সুখের! তাদের আনন্দ অবর্ণনীয় যারা আল-কুরআনের পরিবারের সদস্য, আল-কুরআনের সাথী। যাদের জিহ্বা কুরআনের আয়াত পাঠে সিক্ত, কণ্ঠ কুরআনের সুললিত সুরে অনুরণিত, অন্তর কুরআনের প্রেরণায় উদ্বেলিত, কর্ণ কুরআন শ্রবণে আলোড়িত, দৃষ্টি কুরআন পাঠে নিষ্পলক, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কুরআনের শিক্ষা বাস্তবায়নে তৎপর – তারা আখিরাতের পূর্বে দুনিয়াতেই যেন জান্নাতে পেয়েছে! তাদের ওপর অবর্তীর্ণ হয় প্রশান্তি, রহমত ও মালাইকা [ফেরেশতা], আর উর্দ্ধজগতে চলে তাদের স্তুতি – স্বয়ং আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করেন!
وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللَّهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللَّهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللَّهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ
যখনই একদল লোক আল্লাহর ঘরসমূহের কোন একটি ঘরে মিলিত হয়ে কুরআন পাঠ করে এবং পরস্পরের মাঝে তা অধ্যয়ন করে, তখনই তাদের উপর প্রশান্তি অবতরণ করে, রহমত তাদেরকে আচ্ছন্ন করে, ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তীদের নিকট তাদেরকে স্মরণ করেন। 3
স্বয়ং আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করেন! তারা আল কুরআনের পরিবার। তারা আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন!
عن أنس بن مالك قال: - قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( أن لله أهلين من الناس ) قالوا يا رسول الله من هم ؟ قال ( هم أهل القرآن أهل الله وخاصته )
আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নিশ্চয়ই মানুষের মাঝে রয়েছে আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন।” তাঁরা বললেন: “তারা কারা হে আল্লাহর রাসূল?” তিনি বললেন: “তারা আল-কুরআন চর্চাকারী, তারা আল্লাহর ‘আহল’ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।” 4
এই হাদীসে তাদেরকে বলা হয়েছে আল-কুরআনের ‘আহল’, আল্লাহর ‘আহল’ তথা পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যেমন মানুষের নিকটজন, তেমনি তারা আল-কুরআনকে তাদের নিকটতম সঙ্গী বানিয়েছে – ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিশেষভাবে তাঁর নৈকট্যের জন্য বাছাই করেছেন! যদি কারও সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হতে হয়, তবে নি:সন্দেহে এরাই ঈর্ষার সর্বাধিক যোগ্য:
لَا حَسَدَ إِلَّا فِي اثْنَتَيْنِ رَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ الْقُرْآنَ فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ وَرَجُلٌ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا فَهُوَ يُنْفِقُهُ آنَاءَ اللَّيْلِ وَآنَاءَ النَّهَارِ
দুটি বিষয় ছাড়া কোন কিছুতেই ঈর্ষা বৈধ নয়। এমন ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ্‌ কুরআন দিয়েছেন আর সে তা রাতদিন তিলাওয়াত করে, আর এমন ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ্‌ সম্পদ দিয়েছেন আর সে রাতদিন তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। 5
যদি “ঈর্ষনীয় সাফল্য” বলে পার্থিব জীবনে কিছু থাকে, তবে তা এখানেই!
আল-কুরআন যেন তার পরিবারের এই লোকদের সমস্ত দু:খ-দুশ্চিন্তাকে বুকে টেনে নিয়ে তাদেরকে প্রশান্তির শীতল ছায়ায় আশ্রয় দিয়েছে – তাই তো দু:খকষ্ট, দুশ্চিন্তা ও আশংকা দূর করতে আল্লাহর রাসূল দোয়া শিখিয়েছেন:
مَا أَصَابَ أَحَدًا قَطُّ هَمٌّ وَلَا حَزَنٌ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ أَمَتِكَ نَاصِيَتِي بِيَدِكَ مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي وَنُورَ صَدْرِي وَجِلَاءَ حُزْنِي وَذَهَابَ هَمِّي إِلَّا أَذْهَبَ اللَّهُ هَمَّهُ وَحُزْنَهُ وَأَبْدَلَهُ مَكَانَهُ فَرَجًا قَالَ فَقِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلَا نَتَعَلَّمُهَا فَقَالَ بَلَى يَنْبَغِي لِمَنْ سَمِعَهَا أَنْ يَتَعَلَّمَهَا
যখনই কেউ দুশ্চিন্তা কিংবা দুঃখে পতিত হয় এবং বলে: “হে আল্লাহ, আমি আপনার বান্দা, আপনার দাসের সন্তান, আপনার দাসীর সন্তান, আপনার হাতে আমার চুলের অগ্রভাগ [অর্থাৎ আমি সম্পূর্ণরূপে আপনার ক্ষমতার অধীন ও নিয়ন্ত্রণে], আমার ব্যাপারে আপনার হুকুম কার্যকর, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা ইনসাফপূর্ণ, আমি আপনার এমন প্রতিটি নামের বদৌলতে আপনার কাছে চাই - যার দ্বারা আপনি নিজেকে নামকরণ করেছ, অথবা আপনার সৃষ্টির কাউকে শিখিয়েছেন কিংবা আপনার কিতাবে তা নাযিল করেছেন অথবা আপনার গায়েবের জ্ঞানে একচ্ছত্রভাবে সংরক্ষিত রেখেছেন - “আপনি আল কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের বসন্ত, আমার অন্তরের আলো, আমার দুঃখের অপসারণ এবং আমার দুশ্চিন্তার প্রস্থান” - আল্লাহ পাক তাঁর দুশ্চিন্তা ও দুঃখ দূর করে দেন এবং এর পরিবর্তে প্রশস্ততা দান করেন। বলা হল: হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি তা শিখব না? তিনি বললেন: অবশ্যই, যে এটা শুনল তার তা শিখে নেয়া উচিৎ। 6
আর কেয়ামত দিবসে তার জন্য অপেক্ষা করছে উচ্চ মর্যাদার আসন! এই সংকটপূর্ণ দিনটিতে সে থাকবে সম্মানিত লেখক কিংবা ওহীর বাহক ফেরেশতাদের কাতারে:
الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السَّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَة
আল-কুরআন দক্ষ পাঠকারী [কিয়ামতের দিন] অনুগত ও সম্মানিত বাণীবাহক [অপর ব্যাখ্যামতে লেখক] [ফেরেশতাগণের] সাথে থাকবে। 7
এই কুরআন আয়ত্তকারীকেই কিয়ামতের দিন বলা হবে:
اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِى الدُّنْيَا فَإِنَّ مَنْزِلَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَؤُهَا
কুরআন পাঠ করতে করতে [জান্নাতে] উর্দ্ধারোহণ করতে থাকো এবং দুনিয়াতে যেভাবে তারতীল সহকারে [পরিমিত গতিতে কুরআন তেলাওয়াতের নিয়মকানুন রক্ষা করে] পাঠ করতে অনুরূপভাবে পাঠ কর, কেননা তোমার পাঠের শেষ আয়াতেই হবে তোমার অবস্থান। 8
এই কুরআন কেয়ামতের দিন তার জন্য শাফায়াত করবে:
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنَّهُ يَأْتِى يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ
তোমরা কুরআন পাঠ কর, কেননা কেয়ামতের দিন তার পাঠকারীদের জন্য সে শাফায়াতকারী হবে। 9
এবং বলবে:
مَنَعْتُهُ النَّوْمَ بِاللَّيْلِ فَشَفِّعْنِي فِيهِ
আমি রাত্রিতে তাকে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি সুতরাং [হে আল্লাহ] তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। 10
কেয়ামতের দিন আল-কুরআনকে সে তার পাশে পাবে:
يجيء القرآن يوم القيامة كالرجل الشاحب يقول لصاحبه : هل تعرفني؟ أنا الذي كنت أسهر ليلك وأظمئ هواجرك
কেয়ামতের দিন আল-কুরআন এক মলিন ব্যক্তিরূপে আবির্ভূত হয়ে এর পাঠকারীকে বলবে: আমাকে চেন কী? আমিই সে যে তোমার রাত্রিগুলোকে নিদ্রাহীন ও মধ্যাহ্নগুলোকে তৃষ্ণার্ত করে তুলতাম।...11
হাদীস ব্যাখ্যাকারীগণ উল্লেখ করেছেন যে দুনিয়াতে এই ব্যক্তি যেমনিভাবে কুরআন চর্চার কারণে ক্লান্ত, অবসন্ন, মলিন থাকত, তেমনি কুরআন কেয়ামতের দিন অনুরূপ বেশে আসবে – যেন সে এই ব্যক্তির নাজাতের জন্য ছুটোছুটি করে আজ মলিন হয়েছে!
এখানেই শেষ নয়:
فيعطى الملكَ بيمينه والخلدَ بشماله و يوضع على رأسه تاج الوقار ويكسى والداه حلتين لا تقوم لهما الدنيا وما فيها، فيقولان : يا رب! أنى لنا هذا ؟ فيقال : بتعليم ولدكما القرآن.
অত:পর তার ডান হাতে রাজত্ব ও বাম হাতে চিরজীবন দেয়া হবে এবং তার মাথায় সম্মানের মুকুট পরানো হবে, আর তার মা-বাবাকে দুনিয়া ও এর অন্তর্ভুক্ত সকল বস্তু থেকে উত্তম দুটি পোশাক পরানো হবে। তারা দুজনে বলবে: হে রব! এ আমাদের জন্য কিভাবে অর্জিত হল? বলা হবে: তোমাদের সন্তানকে আল-কুরআন শিক্ষা দেয়ার কারণে।12
এই হাদীস পাঠের পর মা-বাবারা সন্তানদেরকে সর্বাগ্রে আল-কুরআনের আলেম বানাতে সংকল্পবদ্ধ হবেন কী?
শুধু তাই নয়, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন:
يجيء القرآن يوم القيامة فيقول : يا رب حله فيلبس تاجَ الكرامة ثم يقول يا رب زده فيلبس حلةَ الكرامة ثم يقول : يا رب ارض عنه فيرضى عنه
কেয়ামতের দিন আল-কুরআন এসে বলবে: হে রব! তাকে অলংকৃত করুন। ফলে তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। এরপর বলবে: হে রব! তাকে আরও বাড়িয়ে দিন। ফলে তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। এরপর বলবে: হে রব! তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, ফলে তিনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন... 13
কুরআন চর্চাকারীদের এই অতুলনীয় সম্মান ও মর্যাদা হবেই না বা কেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো জানিয়েই দিয়েছেন:
خَيْرُكُمْ مَنْ تَعَلَّمَ الْقُرْآنَ وَعَلَّمَهُ
তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে উত্তম যে কুরআন শেখে এবং অন্যকে শেখায়। 14
আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবকে আঁকড়ে থাকা লোকদেরকেই দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদার আসনে আসীন করবেন:
إِنَّ اللَّهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ এই কিতাবের দ্বারা একদলকে উন্নীত করেন, আর এর দ্বারাই অন্যদেরকে করেন অবনত। 15
আসুন, আজ আমরা সপরিবারে আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরি। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া বিপদগ্রস্ত মানুষ যেভাবে সর্বশক্তি দিয়ে কোন কিছু আঁকড়ে থাকতে চায়, তেমনিভাবে আমরা আঁকড়ে ধরি আল-কুরআনকে – যেন পাপ-পংকিল জীবনের বিষাক্ত স্রোতধারা আমাদেরকে আল্লাহ থেকে সরিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করতে না পারে।
আল-কুরআন হোক পরিবারের প্রাণ, পরিবারের বিনোদন, পরিবারের সকল কর্মকাণ্ডের মূল। পরিবারগুলো ভরে যাক ছোট-বড় সকলের কণ্ঠে ভেসে আসা আল-কুরআনের সুরের মূর্ছনায়:
زَيِّنُوا الْقُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ، فَإِنَّ الصَّوْتَ الْحَسَنَ يَزِيدُ الْقُرْآنَ حُسْنًا
তোমরা তোমাদের কণ্ঠের দ্বারা আল কুরআনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত কর, কেননা নিশ্চয়ই সুন্দর কণ্ঠ আল-কুরআনের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়। 16
لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ
যে সুললিত উচ্চকণ্ঠে কুরআন পাঠ করে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। 17
আর আল-কুরআন পাঠে সুন্দরতম কণ্ঠ সেই ব্যক্তির, যে আল-কুরআনের অর্থ অনুধাবন করে আল্লাহর প্রতি ভয়-ভীতি ভালবাসা সহকারে অন্তর থেকে তা পাঠ করে:
إِنَّ مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ صَوْتًا بِالْقُرْآنِ الَّذِي إِذَا سَمِعْتُمُوهُ يَقْرَأُ حَسِبْتُمُوهُ يَخْشَى اللَّهَ
আল-কুরআন পাঠে সর্বোত্তম সুরের অধিকারী ঐ ব্যক্তি যাকে পাঠ করতে শুনলে তোমাদের মনে হয় সে আল্লাহকে ভয় করছে। 18
আসুন পরিবারের সকলে আল-কুরআনের তিলাওয়াত, সাধ্যমত হিফয, তাফসীর পাঠ ও অনুধাবন, আল কুরআনের শিক্ষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা, আমলে এর বাস্তবায়ন, মানুষকে কুরআন শিক্ষা দেয়া, আল-কুরআনের অধ্যয়ন ও আলোচনা করা, রাত্রির সালাতে আল-কুরআনের তিলাওয়াত ও আল-কুরআনের দিকে মানুষকে আহ্বান জানানোর মত কাজগুলোকে জীবনের মূল ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে নিয়মিত তা করি – যেন আমরা আল-কুরআনের সাথী হতে পারি, যেন সেই মহাসৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারি যারা আল্লাহর ঘনিষ্ঠ, যাদেরকে তিনি উর্দ্ধজগতে স্মরণ করেন, যাদের জন্য আল-কুরআন দুনিয়াতে সমস্ত দু:খ-দুর্দশা-দুশ্চিন্তার কবল থেকে আশ্রয় এবং আখিরাতে সুপারিশকারী।
আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি যেন তিনি আমাদের পরিবারগুলোতে আল-কুরআনের পরিবেশ তৈরী করে দেন।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যাদের জন্য আল-কুরআন কেয়ামতের দিন দলীল ও সুপারিশকারী হবে। আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যাদের সম্পর্কে আল কুরআন বলবে: “আমি তাকে রাত্রিতে নিদ্রা থেকে বিরত রেখেছি, অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন!” আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যাদেরকে বলা হবে: “কুরআন পাঠ করতে করতে [জান্নাতে] উর্দ্ধারোহণ করতে থাকো এবং দুনিয়াতে যেভাবে তারতীল সহকারে পাঠ করতে অনুরূপভাবে পাঠ কর, কেননা তোমার পাঠের শেষ আয়াতেই হবে তোমার অবস্থান।” হে আল্লাহ আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করবেন না যাদের সম্পর্কে রাসূল অভিযোগ দেবেন:
وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا(৩০)
...হে আমার রব, নিশ্চয়ই আমার জাতি এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছে।
19
হে আল্লাহ! আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যাদের নাজাতের জন্য কেয়ামতের দিন আল-কুরআন সচেষ্ট ও সঞ্চালিত হবে, যাদের সম্পর্কে আপনি বলেছেন:
الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَٰئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ ۗ… (১২১)
যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তা পাঠ করে যথার্থভাবে। তারাই এর প্রতি ঈমান রাখে... 20
দৃষ্টি আকর্ষণ:
উপরের আলোচনার অর্থ এই নয় যে আমরা হাদীসকে বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে আল-কুরআনের প্রতি আহ্বান করছি। বরং আমরা বিশ্বাস করি যে হাদীস অধ্যয়ন ছাড়া আল-কুরআনকে সঠিকভাবে বোঝা অসম্ভব – তাই আল-কুরআন অধ্যয়নের আহ্বানের মাঝেই হাদীস চর্চার দাওয়াত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে – কেননা ওহীর এই দুই প্রকার একটি অপরটি থেকে অবিচ্ছেদ্য। যারা হাদীসকে বাদ দিয়ে এককভাবে আল-কুরআনের প্রতি আহ্বান করে, তারা বিভ্রান্ত এবং তারা সর্বাগ্রে আল-কুরআনের শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যানকারী, কেননা আল-কুরআনেই স্বয়ং আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন:
… وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ(৭)
রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে তিনি তোমাদের নিষেধ করেন তা থেকে বিরত হও এবং আল্লাহকেই ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর৷ 21
হাদীসকে বাদ দিয়ে যারা কুরআনকে ব্যাখ্যা করে, তারা মূলত: নিজদের কামনা-বাসনা প্রবৃত্তি অনুযায়ী আল-কুরআনকে ব্যাখ্যাকারী – বরং এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে তারা নিজদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর চেয়েও উচ্চতর মর্যাদার আসনে আসীন করার প্রয়াস পায়, আর তাই তাঁর ব্যাখ্যাকে বাদ দিয়ে তারা নিজদের মনগড়া দর্শন অনুযায়ী আল-কুরআনকে ব্যাখ্যার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে। আল্লাহ তাআলা এই বিভ্রান্তির কবল থেকে মুসলিমদেরকে রক্ষা করুন।
এ কথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে বর্তমান জড়বাদের যুগে মানুষের অন্তর ও এর প্রয়োজনগুলো সবচেয়ে উপেক্ষিত। এমনকি কুরআন ও সহীহ হাদীস ভিত্তিক ইসলাম পালনের যে নবজাগরণ মুসলিম বিশ্বে পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা-ও অনেক ক্ষেত্রে বাহ্যিকতার দিকে বেশি ঝুঁকে আছে। ফলে আজ অনেকেই সালাত, সাওম, হাজ্জ্ব প্রভৃতি ইবাদতের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক পালন করলেও তাদের আদব-আখলাক ও আচার-আচরণে ঘটছে অন্তরের বিবিধ রোগের বহি:প্রকাশ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ পাচ্ছে ইসলামের মৌলিক আকীদা বা মূলনীতি বিরোধী আচার-আচরণ – যা অন্তরের ছোটখাট রোগ নয় বরং বড় ধরনের ব্যাধির লক্ষণ!
অন্তর অবহেলিত! অথচ অন্তরের পরিবর্তনই পরিবর্তনের মূল, অন্তরের সুস্থতাই সুস্থতার মূল, অন্তরের সংশোধনই সংশোধনের মূল। আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَوْمَ لَا يَنْفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ(৮৮) إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ(৮৯)
যেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবে না। তবে যে আল্লাহর কাছে আসবে সুস্থ অন্তরে।22
অর্থাৎ একমাত্র সুস্থ অন্তরের অধিকারীরাই কেয়ামত দিবসের বিপদকে এড়াতে সক্ষম হবে। তারা ঐ সমস্ত লোক যারা অন্তরকে শিরক, কুফর, সন্দেহ, রিয়া, অহংকার, লোভ-লালসা, কার্পণ্য, বিদাত ও পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ, মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ ও অনুরূপ অন্যান্য রোগ থেকে মুক্ত করতে পেরেছে, সেই সাথে অন্তরে লালন করেছে এর বিপরীত বৈশিষ্ট্য – আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, তাঁর সওয়াব ও জান্নাতের আশা, তাঁর শাস্তি ও জাহান্নামের ভয়, তাঁর ওপর আস্থা ও নির্ভরতা তথা তাওয়াক্কুল, আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে সুধারণা, দৃঢ় ঈমান ও ইয়াকীন, সবর ও শোকর, ইখলাস বা একনিষ্ঠতা, কুরআন ও সহীহ হাদীসভিত্তিক বিশুদ্ধ জ্ঞান, কল্যাণকামনা... ইত্যাদি।
আল-কুরআনের বহু আয়াতে অন্তরের রোগ ও বিভিন্ন অবস্থা সংক্রান্ত আলোচনা থাকলেও আজ মুসলিমরা এ দিকটিতে অমনোযোগী। আল কুরআনকে শুধুমাত্র অন্তরের রোগের নির্দেশিকাই করা হয়নি, বরং এতে রাখা হয়েছে এসব রোগের উপশম ও অন্তরের পরিশুদ্ধি:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ(৫৭)
হে মানুষ, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে উপদেশ এবং অন্তরসমূহে যা থাকে তার শিফা [চিকিৎসা বা উপশম], আর মুমিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত।23
সুতরাং স্পষ্টতই মানুষের অন্তরের রোগের শিফা রয়েছে আল কুরআনে! আর অন্তরের চিকিৎসা বলতে এখানে কুরআনের দ্বারা ঝাড়ফুঁক বা না বুঝে কুরআন পাঠকে বোঝানো হয়নি। যেহেতু এই আয়াতে আল-কুরআনকে ‘অন্তর’ এর শিফা বলা হয়েছে, অতএব এ কথা স্পষ্ট যে তা নিহিত আছে মূলত এর অর্থ ও শিক্ষার মাঝে।
অন্য আয়াতে আল-কুরআনকে সাধারণভাবে শিফা বলা হয়েছে:
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ۙ وَلَا يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلَّا خَسَارًا(৮২)
আর আমি কুরআন নাযিল করি যা মুমিনদের জন্য শিফা ও রহমত, কিন্তু তা যালিমদের ক্ষতিই শুধু বাড়ায়। 24
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে কুরআন এমনকি দৈহিক রোগেরও শিফা – যা সুন্নাহর মাধ্যমে আরও স্পষ্ট করা হয়েছে। এর একটি নমুনা নিম্নোক্ত হাদীসটি:
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا اشْتَكَى يَقْرَأُ عَلَى نَفْسِهِ بِالْمُعَوِّذَاتِ وَيَنْفُثُ فَلَمَّا اشْتَدَّ وَجَعُهُ كُنْتُ أَقْرَأُ عَلَيْهِ وَأَمْسَحُ بِيَدِهِ رَجَاءَ بَرَكَتِهَا
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অসুস্থ হলে নিজের ওপর মুআওউইযাত [সূরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস] পাঠ করতেন ও ফুঁ দিতেন, অতঃপর যখন তাঁর যন্ত্রণা বেড়ে গেল, আমি তাঁর ওপর পাঠ করতাম এবং তাঁর নিজের হাত [তাঁর দেহে] বুলিয়ে দিতাম এর বরকতের আশায়।25
সুতরাং এতে সন্দেহ নেই যে আল-কুরআনের দ্বারা ঝাড়ফুঁক করার মাধ্যমে দৈহিক রোগ থেকে মুক্তি সম্ভব, কিন্তু এটাই কি কুরআন নাযিলের মূল কারণ?
না। বরং আল-কুরআন আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন এজন্য যে মানুষ তা তিলাওয়াত করবে, এর অর্থ উপলব্ধি করবে, এর অর্থ ও শিক্ষা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবে – আর এই শেষোক্ত কাজটিকে আল-কুরআনের পরিভাষায় নামকরণ করা হয়েছে: ‘আত-তাদাব্বুর’। আর এই তাদাব্বুরই যে আল কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য, তার প্রমাণ আল্লাহর তাআলার বাণী:
كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ(২৯)
এ এক বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার ওপর নাযিল করেছি [হে নবী!], যেন মানুষ এর আয়াতগুলো নিয়ে ‘তাদাব্বুর’ [গভীর চিন্তা-ভাবনা] করে এবং যেন বোধশক্তি সম্পন্ন লোকেরা উপদেশ গ্রহণ করে।26
শুধু তাই নয়, তাদাব্বুর না করার জন্য আল্লাহ তাআলা একদল লোককে তিরস্কার করেছেন:
أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَىٰ قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا(২৪)
তবে কি তারা কুরআন নিয়ে ‘তাদাব্বুর’ [গভীর চিন্তা-ভাবনা] করে না? বরং তাদের অন্তরগুলো তো তালাবদ্ধ।27
আল-কুরআনের অর্থ বোঝা ও তা নিয়ে চিন্তাভাবনা না করা অন্তর তালাবদ্ধ হওয়ার লক্ষণ!
তাদাব্বুর এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? কেননা একজন ব্যক্তি যখন আল-কুরআনের অর্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং নিজের জীবনকে আল-কুরআনের আয়নায় দেখার প্রয়াস পায়, তখনই তার পরিবর্তনের সূচনা হয়। আর এ কাজটি মূলত আমলের মাধ্যমে আল-কুরআনের বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ।
আশ-শায়খ আব্দুর রহমান বিন নাসির আস সাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন:
জেনে রাখ নিশ্চয়ই তাফসীর শাস্ত্র কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই সব শাস্ত্রের মাঝে সবচেয়ে মহান, সর্বোত্তম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং আল্লাহর নিকট এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়, কেননা আল্লাহ তাঁর কিতাব নিয়ে ‘তাদাব্বুর’ করা, এর অর্থ নিয়ে গবেষণা এবং এর আয়াত থেকে হেদায়েত গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, এবং এগুলোর সম্পাদনকারীদেরকে প্রশংসা করেছেন, তাদেরকে সর্বোচ্চ মর্তবা দিয়েছেন, তাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাই বান্দা যদি এই শাস্ত্রের পেছনে তাঁর জীবনের সমস্ত সম্পদও ব্যয় করে, তবুও তা এর তুলনায় খুব বেশি হবে না - যা কিনা সর্বোত্তম লক্ষ্য, সর্ববৃহৎ কাম্য, সকল মূলনীতির মূল, দুই জীবনে সুখশান্তি এবং দীন, দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয়ের সংশোধনের ভিত্তিপ্রস্তর, আর এর দ্বারাই বান্দার জন্য হেদায়েত, কল্যাণ ও রহমতের দ্বারা আলোকিত জীবন অর্জিত হয়, আর আল্লাহ তাঁর জন্য সহজ করেন সর্বোত্তম জীবন এবং নেক আমল।[শারহ আল-কাওয়াইদ আল-হিসান ফী আত-তাফসীর আল-কুরআন, ৮।]
তাদাব্বুর পরিবর্তনের সূচনা, তাদাব্বুর আমলের সূচনা। আর তাদাব্বুর অন্তরের কাজ। আল্লাহ তাআলা আল কুরআন নাযিল করেছেন মানুষের অন্তরের সংশোধনের জন্য। কেননা অন্তর সংশোধিত হলে সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমল সংশোধিত হবে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
أَلاَ وَإِنَّ فِى الْجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلُّهُ أَلاَ وَهِىَ الْقَلْب
নিশ্চয়ই দেহে একটি মাংসপিণ্ড আছে যা সংশোধিত হলে গোটা দেহ সংশোধিত হয় আর যা কলুষিত হলে গোটা দেহ কলুষিত হয় – নিশ্চয়ই তা ক্বলব। 28
একমাত্র সুস্থ নফসের অধিকারই মুক্তি পাবে, অথচ নফসের রয়েছে বহু রোগ। আর এই নফসই হচ্ছে সেই পণ্য যা আল্লাহ তাআলার কাছে বিক্রি করে জান্নাত ক্রয় করতে হবে, আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ۚ… (১১১)
নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন এর বিনিময়ে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।…29
ইবনুল কায়্যিম রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন:
অন্তরের রয়েছে ইবলীসের অহমিকা, কাবিলের ঈর্ষা, আদের অবাধ্যতা, সামূদের সীমালঙ্ঘন, নমরূদের দু:সাহস, ফিরআউনের অনাচার, কারূনের যুলুম, শনিবারের লোকদের প্রতারণা, ওয়ালীদের দুষ্টপ্রকৃতি, আবু জাহলের মূর্খতা, কাকের কার্পণ্য, কুকুরের লোভ, ময়ূরের অস্থিরতা, গুবরে পোকার নীচতা, গিরগিটির দুরাচার, উটের বিদ্বেষ, চিতাবাঘের আকস্মিকতা, সিংহের আক্রমণ, ইঁদুরের অনিষ্ট, সাপের নোংরামি, বাঁদরের দুষ্টামি, পিঁপড়ার সঞ্চয়, শেয়ালের ষড়যন্ত্র, প্রজাপতির ওজনহীনতা, হায়নার ঘুম... কেবল পার্থক্য হল চর্চা ও সাধনার দ্বারা তা দূর করা সম্ভব, আর যে তার প্রকৃতিতে অটল থাকে, সে এদের দলভুক্ত, তাদের পণ্য বিক্রয়ের যোগ্য নয় “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমনিদের কাছ থেকে তাদের নফসকে ক্রয় করে নিয়েছেন...”।30
সুতরাং নফসের মন্দ বৈশিষ্ট্যগুলো জানা ও এ থেকে নফসকে মুক্ত করা চাই।
অন্তরের রয়েছে বিভিন্ন রোগ। যেমন: শিরক, কুফর, নিফাক, সন্দেহ, অহংকার, ঈর্ষা, লোভ-লালসা, কার্পণ্য, ষড়যন্ত্র, আত্মপ্রবঞ্চনা, বিদ্বেষ... এবং আরও অন্যান্য। তেমনি অন্তরের সুস্থতার জন্য রয়েছে অনিবার্য কিছু অবস্থা, যা অন্তরে থাকা চাই, যেমন: আল্লাহর প্রতি ভালবাসা, তাঁর পুরস্কারের আশা, তাঁর শাস্তির ভয়, একমাত্র তাঁর ওপর অন্তরের আস্থা ও নির্ভরতা - যাকে তাওয়াক্কুল বলা হয়, ইখলাস বা একনিষ্ঠতা, আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা... ইত্যাদি।
অন্তরের পরিশুদ্ধি হল এই সমস্ত রোগ থেকে একে মুক্ত করা এবং এর প্রয়োজনীয় গুণাবলীতে একে পূর্ণ করা।
অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার কাজটি একটি সময়সাপেক্ষ চলমান প্রক্রিয়া, এর জন্য চাই সদিচ্ছা, ধৈর্য, আল্লাহ তাআলার সাহায্য-প্রার্থনা ও সর্বোপরি নিয়মিত কুরআন ও হাদীসের বাণীতে অন্তরের অবগাহন।
কুরআন ও হাদীসের বাণীতে অন্তরের অবগাহন অর্থ:
প্রথমত: অন্তরে কুরআন ও হাদীসের বাণীর অর্থকে গভীরভাবে প্রবেশ করানো এবং
দ্বিতীয়ত: অন্তরকে কুরআন ও হাদীসের এই শিক্ষার সাথে মেলানো এবং ফলশ্রুতিতে প্রাপ্ত অসামঞ্জস্য দূরীকরণ।
এ কাজটি সুসম্পন্ন করতে নিয়মিত কুরআন ও হাদীসের অর্থ অধ্যয়ন ও এ নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার জন্য যথেষ্ট সময় ব্যয় করা প্রয়োজন।
আজ মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য নতুন করে আল্লাহর কিতাবকে হাতে তুলে নেয়া। শুধু তেলাওয়াতের বরকতের উদ্দেশ্যে বা তাবিজ বানানো 31 অথবা ঘর থেকে শয়তান জ্বিন তাড়ানো কিংবা মৃতের জন্য সওয়াব হাসিলের নিমিত্তে নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্য তথা আত্মশুদ্ধি সম্পাদনের স্বার্থে!
নতুন করে আল-কুরআনকে হাতে তুলে নিতে হবে অন্তরকে নিষ্কলুষ করতে, যেন একে আখিরাতে জাহান্নামের উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিশুদ্ধ করতে না হয়‍‍:
نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ(৬) الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ(৭)
আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত আগুন৷ যা হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত পৌঁছে যাবে৷ 32
এর চাইতে একে আল-কুরআনের শীতল বারিধারায় স্নাত করা সহজ এবং তা আনন্দদায়কও বটে। উপরন্তু আল-কুরআনের স্রোতস্বিনীতে অন্তরের অবগাহন দুনিয়াতেই মুমিনের সুখশান্তি - তা দুনিয়াতেই মুমিনের জান্নাত! আল্লাহ তাআলা বলেন:
… أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ(২৮)
...জেনে রাখ, আল্লাহর ‘যিকির’ এর দ্বারাই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়। 33
আর নি:সন্দেহে আল্লাহ তাআলার যিকর তথা স্মরণের অন্যতম উপায় হল আল-কুরআন পাঠ।
আল-কুরআনের আলোয় নতুন করে উদ্ভাসিত, পরিশুদ্ধ ও পুনরুজ্জীবিত হতেই আমাদের এই প্রয়াস:

আশ-শিফা: কুরআনের আলোয় আত্মশুদ্ধি।

যেহেতু হাদীসও আল্লাহ তাআলার ওহী, এবং হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আল-কুরআনকে বোঝা অসম্ভব, তাই আল-কুরআন বোঝার প্রচেষ্টায় হাদীসের শরনাপন্ন হওয়া অনিবার্য – আর তাই আমরা আল্লাহর কিতাবের পাশেই রাখছি তাঁর খলীল সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর সুন্নাহকে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
… وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ(৪৪)
...আর তোমরা প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে তা স্পষ্ট করে দিতে পার, আর যাতে তারা চিন্তা করে৷ 34
আল-কুরআনের আলোয় আত্মশুদ্ধির এই যাত্রায় আমরা সূরা আল-ফাতিহা দিয়ে আলোচনা শুরু করব ইনশা আল্লাহ। পাঠকদের জন্য আমাদের দুটি পরামর্শ:
এক. আত্মশুদ্ধি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, তাই আসুন আমরা এই প্রক্রিয়ার সাথে লেগে থাকি: নিয়মিত অধ্যয়ন করি, তাদাব্বুর করি ও আমলে বাস্তবায়ন করি।
দুই. মানুষের অন্তর আল্লাহ তাআলার দুই আঙ্গুলের মাঝে:
« إِنَّ قُلُوبَ بَنِى آدَمَ كُلَّهَا بَيْنَ إِصْبَعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ الرَّحْمَنِ كَقَلْبٍ وَاحِدٍ يُصَرِّفُهُ حَيْثُ يَشَاءُ »
নিশ্চয়ই আদম সন্তানের সকল অন্তর পরম করুনাময়ের আঙ্গুলগুলোর মধ্য থেকে দুটি আঙ্গুলের মাঝে – যেন তা একটি অন্তর – তিনি একে যেভাবে ইচ্ছা আন্দোলিত করেন। 35
তাই অন্তরের পরিশুদ্ধি সম্পন্ন করার জন্য সকল প্রচেষ্টা ব্যয় করার সাথে সাথে দোয়ার মাধ্যমে অন্তরের মালিকের কাছে ধরনা দিতে হবে:
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قُلُوبَنَا عَلَى دِينِكَ
হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী আমাদের অন্তরগুলোকে আপনার দ্বীনের ওপর সুস্থির করে দিন। 36
  1. সূরা আর-রাদ, ১৩:২৮।
  2. মুসলিম(৮০৫)।
  3. মুসলিম(২৬৯৯)।
  4. ইবনে মাজাহ(২১৫)।
  5. বুখারী(৪৭৩৭), মুসলিম(৮১৫)।
  6. আহমদ(৩৭১২)।
  7. মুসলিম(৭৯৮)।
  8. আহমদ(৬৭৯৯), আবু দাউদ(১৪৬৪), তিরমিযী(২৯১৪)।
  9. মুসলিম(৮০৪)।
  10. আহমদ(৬৬২৬)।
  11. আস সিলসিলা আস সাহীহাহ (২৮২৯)।
  12. আস সিলসিলা আস সাহীহাহ (২৮২৯)।
  13. আত-তিরমিযী(২৯১৫)।
  14. বুখারী(৪৭৩৯)।
  15. মুসলিম(৮১৭)।
  16. হাকিম(২১২৫)।
  17. বুখারী(৭৫২৭)।
  18. ইবনু মাজাহ(১৩৩৯)।
  19. সূরা আল-ফুরকান, ২৫ : ৩০।
  20. সূরা আল-বাকারা, ২:১২১
  21. সূরা আল-হাশর, ৫৯:৭।
  22. সূরা আশ্‌-শু'আরা, ২৬:৮৮-৮৯।
  23. সূরা ইউনুস, ১০ : ৫৭।
  24. সূরা আল-ইসরা, ১৭:৮২।
  25. বুখারী(৪৪৩৯), মুসলিম(২১৯২)।
  26. সূরা সোয়াদ, ৩৮:২৯।
  27. সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭:২৪।
  28. বুখারী(৫২), মুসলিম(১৫৯৯)।
  29. সূরা আত্‌-তাওবা, ৯:১১১।
  30. আল ফাওয়াইদ পৃ: ৭৬।
  31. মূলত: তাবিজ পরিধান এক প্রকার শিরক। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
    « إِنَّ الرُّقَى وَالتَّمَائِمَ وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ »
    ঝাড়ফুঁক, তাবিজ এবং তিওয়ালা[এক প্রকার যাদু, যা স্বামী-স্ত্রীর মনের মিল ঘটায় বলে দাবী করা হয়।] শিরক।[আহমদ(৩৬১৫), আবু দাউদ(৩৮৮৩)।]
  32. সূরা আল-হুমাযাহ, ১০৪:৬-৭
  33. সূরা আর-রাদ, ১৩:২৮।
  34. সূরা আন-নাহল, ১৬:৪৪।
  35. মুসলিম(২৬৫৪)।
  36. আহমদ(১৭৬৬৭)।

No comments:

Post a Comment