From OIEP
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মা-বাবা
কর্তৃক সংঘটিত এমন কিছু ভুল আমাদের পরিবারগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে, যার ব্যাপারে
সমাজের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় এগুলোকে ত্রুটি হিসেবে চিহ্নিতই করা হয় না –
অথচ তা সন্তানদের বহু সমস্যার মূল।
এখানে ২০টি ভুল নিয়ে আলোচনা করা হল।
এগুলোর প্রভাবকে আমরা শক্ত পাথরে ক্রমাগত ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার মত ভাবতে
পারি – একটু বিলম্বে হলেও তা পাথরকে ক্ষয় করেই ছাড়বে!
আমরা সাধারণত এই সমস্যাগুলোর ব্যাপারে
উদাসীন থেকে একদিন যখন সন্তানদেরকে নিয়ে বড় বিপদে পড়ে যাই, তখন আকস্মিক
সমাধান খুঁজি এবং এমন কিছু করে বসি যা প্রথম ভুলের তুলনায় আরও বেশি
মারাত্মক।
বরং চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ার আগেই রোগ প্রতিরোধ কাম্য।
১. ক্রোধের ধারাবাহিক স্থানান্তর
জীবনযুদ্ধে জর্জরিত বাবা অনেক সময় প্রেসার
কুকারের চাপমুক্ত হওয়ার মত ক্রোধ বা হতাশার বাষ্প ছড়িয়ে দেন সন্তানদের
কিংবা তাদের মায়ের মধ্যে, পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে এর স্থানান্তর চলতে থাকে
জন থেকে জনে। এর বহি:প্রকাশ ঘটে লঘু পাপে গুরু দণ্ড কিংবা সামান্য কারণে
সন্তানদের ওপর রাগারাগি কিংবা তাদেরকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে।
তাই রেগে যাওয়ার আগে নিজেকে সামলানোর
অভ্যাস গড়ে তোলা চাই। আমাদের সন্তানরা যেন কর্মক্ষেত্রে কিংবা অন্যত্র
আমাদের ব্যর্থতার ক্ষোভের লাভা উদ্গিরণের লক্ষ্যবস্তু না হয়।
২. প্রকাশ্যে বাচ্চাদের দোষত্রুটি বলা
বাচ্চা বিছানায় প্রস্রাব করে কিংবা তোতলায়
– এ ধরনের বিষয়গুলো অন্যদের সম্মুখে আলোচনা বাচ্চাদের জন্য মর্মবেদনার
কারণ। এ ধরনের মর্মবেদনা অনেক বাচ্চার অবাধ্যতা বা উগ্র আচরণের কারণ হতে
পারে। তেমনি যা কিছু উল্লেখ করা তাদের মনোকষ্টের কারণ তা উল্লেখ করা থেকে
বিরত থাকা উচিৎ। অনেক সময় বাচ্চারা মজার কিছু করে থাকে যা মা-বাবা সবার
সাথে শেয়ার করতে চান, কিন্তু বাচ্চারা চায় না সেটা বলা হোক।
৩. গুপ্তচরবৃত্তি
বাচ্চারা কি করে, কার সাথে মেশে সে বিষয়ে
অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে, কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তি ক্ষতিকর। এতে মা-বাবার সাথে
সন্তানের আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়। সন্তানরা কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করলেও তাদের
ওপর গুপ্তচরবৃত্তি নয়। এখানে গুপ্তচরবৃত্তির দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়মিত তাদের
ব্যাগ, পোশাক এগুলো চেক করা। বাচ্চার বন্ধুর বাসায় গিয়ে হঠাৎ হাজির হওয়া
ইত্যাদি।
৪. সিসি ক্যামেরা!
তেমনি বাচ্চাদের ওপর সিসি ক্যামেরার মত ২৪
ঘণ্টা নজরদারি নয়। অবশ্য এর পাশাপাশি এমন পরিবেশ তৈরী করতে হবে যেন
নজরদারির প্রয়োজন না পড়ে। যেমন বাচ্চাদের হাতে এমন কোন ইন্টারনেট অ্যাকসেসই
থাকবে না যা তারা গোপনে ব্যবহার করতে পারে। তাদেরকে অন্যায়ের সুযোগ করে
দিয়ে তারপর ২৪ ঘন্টা নজরদারি ও সন্দেহ পোষণ যেন চোর ধরার জন্য টোপ দিয়ে তার
ফাঁদে আটকানোর অপেক্ষা।
৫. মারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
مَا ضَرَبَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه
وسلم- شَيْئًا قَطُّ بِيَدِهِ وَلاَ امْرَأَةً وَلاَ خَادِمًا إِلاَّ أَنْ
يُجَاهِدَ فِى سَبِيلِ اللَّهِ
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ছাড়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম কখনও কোন কিছুকে হাত দিয়ে আঘাত করেননি: কোন নারীকে নয়, কোন
খাদেমকেও নয়…
মুসলিম(২৩২৮)
আমরা যারা নবীর সুন্নাতের অনুসারী হতে চাই, তাদের উচিৎ সুন্নাতের এ দিকগুলোকে জীবনে ধারণ করতে সচেষ্ট হওয়া।
৬. সকল বিষয়ে হস্তক্ষেপ
সন্তানদের সকল বিষয়ে নিজেদের
ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়া ও খুঁটি-নাটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ তাদের সাথে
মা-বাবার দূরত্ব তৈরী করার পাশাপাশি তাদের আত্মবিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের
ক্ষমতাকে দুর্বল করে তোলে।
জনৈক বাবার বক্তব্য: “আমার ছেলে কোন
পোশাক, জুতো বা খাবার পছন্দ করার ব্যাপারে পরিবারের সবার থেকে ভিন্ন
মতাবলম্বী। সুতরাং জুতার দোকানে কোন জুতা কদাচিৎ তার পছন্দ হয়। তাই তার
জুতা কেনা এক বড় ধরনের ঝক্কি। অন্যান্য বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত সবার পছন্দ
হলেও তার একটা ভিন্নমত থাকবে। তা সত্ত্বেও আমি তার নিজস্বতাকে যথাসম্ভব
প্রশ্রয় দেয়া ও সম্মান করার চেষ্টা করি।”
যেখানে শরীয়ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে – সেখানে প্রশ্রয়ের সুযোগ নেই। যেখানে শরীয়ত নিরব, সেখানে ছাড় দেয়াই ভাল।
অনেক সময় সন্তানদের সকল বিষয়ে মা-বাবার
বাড়াবাড়ি রকমের হস্তক্ষেপ সময়, সম্পদ ও মেধার অপচয় সহ অন্যান্য ক্ষতির কারণ
হয়। এক ব্যক্তিকে চিনি যার বাবার ইচ্ছায় তিনি ঔষধ গেলার মত ডাক্তারী পড়ার
পর বাকি জীবন ঠিকাদারী করে কাটিয়েছেন!
সন্তানদের বয়স ও পরিপক্কতা বাড়ার সাথে
সাথে মা-বাবার উচিৎ আদেশদাতার পরিবর্তে ক্রমান্বয়ে পরামর্শদাতার ভূমিকায়
অবতীর্ণ হওয়া। বাস্তবতা হল শুধু আদেশ-নিষেধের কড়াকড়ি দিয়ে শেষমেষ নিয়ন্ত্রণ
করাও যায় না, সম্পর্কও সুন্দর রাখা যায় না।
৭. কোন একজন সন্তানকে অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়া
কোন এক সন্তান প্রতিবন্ধী কিংবা গুরুতর
কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত মনোযোগ চলে যাওয়া
স্বাভাবিক, কিন্তু সেটা কাম্য নয়। এর একাধিক ক্ষতি রয়েছে। যেমন অতিরিক্ত
মনোযোগ পেয়ে সে জীবনের বিপদাপদের বাস্তবতায় অভ্যস্ত হওয়ার পরিবর্তে
অস্বাভাবিকভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারে এবং পরিবারের সবাইকে তার
ইচ্ছা-পূরণের বাধ্যবাধকতায় বেঁধে ফেলতে পারে। তেমনি এতে সে নিজ দুর্বলতার
প্রতি অতি মনোযোগী হওয়ার কারণে তার সবল দিকগুলোকে কাজে লাগাতে অক্ষম হয়ে
উঠতে পারে। আবার বাকি সন্তানরা এতে অবহেলার শিকার হতে পারে।
৮. সন্তানকে দিয়ে যেকোন মূল্যে নিজের জীবনের শখ পূরণ
নিজে যা করতে পারিনি সন্তান তা করুক –
আমরা সবাই সেটা চাই। কিন্তু তা যেন সন্তানের ঝোঁক বা সামর্থ্যের ব্যাপারে
উদাসীন থেকে নিজের শখ মেটানোর বিবেচনাহীন প্রয়াস না হয়। আমি ইংরেজীতে
দুর্বল, তাই আমার সন্তানকে যেকোন মূল্যে ইংরেজীর বিশেষজ্ঞ বানাতে হবে – এমন
দৃষ্টিভঙ্গী ক্ষতির কারণ হতে পারে।
৯. নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি
অপরাধ বাড়ার সাথে সাথে নিরাপত্তার গুরুত্ব
বৃদ্ধি পেয়েছে সন্দেহ নেই, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত হলে সন্তানরা
ভীত-সন্ত্রস্ত, আত্মবিশ্বাসহীন, অপরিপক্ক, সিদ্ধান্ত ও দায়িত্ব নিতে অক্ষম
বা অনিচ্ছুক হয়ে বেড়ে উঠতে পারে। এজন্য নিরাপত্তার ব্যাপারে মধ্যপন্থা
অবলম্বনে যত্নবান হতে হবে।
কোন বয়সে কতটুকু দূরত্বে বা কোন কোন
স্থানে একাকী তাদেরকে যেতে দেয়া হবে – সে সিদ্ধান্ত নিরাপত্তার সাথে জড়িত। এ
ব্যাপারে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের পাশাপাশি তাদেরকে নিরাপত্তার উপায় উপকরণ
প্রশিক্ষণ দেয়া উচিৎ, যেমন: নির্জন স্থানে একাকী না যাওয়া, প্রয়োজনে চিৎকার
করা ও দৌড় দেয়া, কেউ অনুসরণ করার ব্যাপারে সজাগ থাকা, বাসার একাধিক
সদস্যের ফোন নম্বর মুখস্থ রাখা ইত্যাদি।
১০. প্রমাণ ছাড়াই অভিযোগ
উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া অভিযোগের আঙ্গুল না
তোলা ইসলামী শরীয়তের অন্যতম একটি শিক্ষা, অপরপক্ষে মিথ্যা অপবাদ একটি
গর্হিত অপরাধ। একজন মুসলিমের ওপর অপর যে কোন মুসলিমের এই অধিকার যেখানে
সাব্যস্ত, সেখানে নিজ পিতা-মাতা, সন্তান কিংবা অন্যান্য আত্মীয়ের ক্ষেত্রে
তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। দুঃখের বিষয় অনেক
মা-বাবাই সন্তানদেরকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে তাকওয়া হারিয়ে ফেলেন এবং
শরীয়তের বিধিনিষেধ ভুলে যান। এমনকি অজ্ঞতার কারণে অনেক মা-বাবা সন্তানকে যা
খুশি বলাকে নিজেদের অধিকার ভাবতে শুরু করেন!
অনেক সময় সন্তানদের মধ্যে যে অপেক্ষাকৃত
চঞ্চল বা দুষ্ট প্রকৃতির, তার ওপর শুরু থেকেই সব দোষ চাপতে থাকে। বিষয়টা
যেন এমন যে তার নির্দোষ হওয়াটাই প্রমাণ-সাপেক্ষ! অথচ ইসলামের নীতি উল্টো –
প্রমাণিত হওয়ার আগে অভিযোগ নয়। ইসলামে হত্যা, ব্যাভিচার, চুরি জাতীয় যে সকল
গুরুতর অপরাধের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে – সেগুলো পর্যন্ত যথেষ্ট সংখ্যক
উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর হতে পারে না।
সন্তানদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া “এটা নিশ্চয়ই অমুকের কাজ” জাতীয় বক্তব্য আমাদেরকে পরিহার করতে হবে।
এ বিষয়টিতে অবহেলা সন্তানদের মনে ক্ষোভ, প্রতিশোধস্পৃহা, মা-বাবার ব্যাপারে অনাস্থার জন্ম দেবে।
১১. সব বিষয়ে সমালোচনা
সকল বিষয়ে সমালোচনা যেকোন মানুষকে
সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম করে তোলে, সন্তানদের ক্ষেত্রে তা অধিকতর প্রযোজ্য।
বরং আলাপচারিতার মাধ্যমে ও গল্পচ্ছলে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংঘটিত
ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিয়ে উন্নততর সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে।
অনেক সময় সন্তানরা অবস্থার প্রেক্ষিতে
আমাদের দিকনির্দেশনার বাইরে গিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে –
এক্ষেত্রে তাদের প্রশংসা করা উচিৎ, যদিও বা ফলাফল আমাদের আশানুরূপ নাও হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
বাবা সন্তানকে বললেন: দোকান থেকে ‘মাকড়শা’
মার্কা কয়েল নিয়ে এস, সেটা না পেলে অন্যটা আনার দরকার নেই। ছেলে ‘বাঘ’
মার্কা কয়েল এনে বলল যে ‘মাকড়শা’ নেই কিন্তু দোকানদার বলেছে ‘বাঘ’ তার
চেয়েও ভাল। এক্ষেত্রে তাকে আগ বেড়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তিরস্কার না করে
বরং উৎসাহিত করা উচিৎ – কেননা এ ধরনের নিত্যনতুন সিদ্ধান্ত নেয়াটা একটা
দক্ষতা যাকে লালন করতে হবে। তবে সেই সাথে তাকে সতর্কতার ক্ষেত্রগুলি চিনিয়ে
দেয়া ভাল, যেমন: হতে পারে দোকানদার তার পণ্য বিক্রির জন্য কথাটি বলেছে,
সেক্ষেত্রে আরও দু একটা দোকানে যাচাই করলে আরও ভাল হত – ইত্যাদি।
১২. ঘন ঘন সমালোচনা
প্রত্যেক ভুল ধরা জরুরী নয়, বরং ক্ষতিকর
হতে পারে। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে প্রতি ৩টি ভুলে একবার সমালোচনা হতে পারে।
ঘন ঘন ভুল ধরার কারণে সন্তানরা মা-বাবার সঙ্গ ও সাক্ষাৎ অপছন্দ করতে শুরু
করবে।
১৩. দোয়া না করাআল্লাহ তাআলা রহমানের বান্দাদের দোয়া উল্লেখ করে বলেন:
وَالَّذِينَ
يَقُولُونَ رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا
قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا
আর যারা বলে, “হে আমাদের রব, আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও
সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে
মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন।”
সূরা আল ফুরকান, ২৫ : ৭৪
সন্তানের জন্য দোয়ার শুরু তার জন্মের আগেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
« لَوْ أَنَّ أَحَدَهُمْ إِذَا أَرَادَ
أَنْ يَأْتِىَ أَهْلَهُ قَالَ بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا
الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا فَإِنَّهُ إِنْ
يُقَدَّرْ بَيْنَهُمَا وَلَدٌ فِى ذَلِكَ لَمْ يَضُرَّهُ شَيْطَانٌ أَبَدًا
»
তোমাদের কেউ তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার সময় যদি বলে বিসমিল্লাহ, আল্লাহুম্মা
জান্নিবনাশ শাইতান ওয়া জান্নিবিশ শাইতানা মা রাযাকতানা [অর্থাৎ হে আল্লাহ
শয়তানকে আমাদের থেকে দূরে রাখুন এবং আমাদের রিযিকে যা দিয়েছেন, তা থেকেও শয়তানকে দূরে রাখুন] তবে তাদের মধ্যে ঐ মিলনের কারণে সন্তান এলে শয়তান তাকে কখনও ক্ষতি করতে পারে না।
বুখারী(১৪১), মুসলিম(১৪৩৪)
আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে হাদীসটিতে
ক্ষতির ব্যাপক অর্থ উদ্দিষ্ট নয়, অর্থাৎ শয়তান সকল আদম সন্তানেরই কোন না
কোন ক্ষতি করতে সক্ষম। তাই এখানে কোন ধরনের ক্ষতির কথা বলা হয়েছে – সে
ব্যাপারে আলেমগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তন্মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য মত এই যে
শয়তান তার ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাকে কুফরীতে লিপ্ত করতে পারবে না।
তেমনি পরবর্তীতেও সকল অবস্থায় সন্তানদের
জন্য দোয়া ও কল্যাণকামনা জরুরী। সন্তান যদি কখনও অবাধ্যও হয়, পাপকাজেও
লিপ্ত হয় – তবে সেক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে বদদোয়া নয়, বরং তার হেদায়েতের
জন্য দোয়া করাই পিতামাতাসুলভ আচরণের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
১৪. অনিয়ন্ত্রিত খেলাধূলা ও বিনোদন
এর সাম্প্রতিক উদাহরণের মধ্যে যা সবচেয়ে
ব্যাপক ও আশংকাজনক মাত্রায় বিরাজমান, তা হল কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন ও
অনুরূপ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসে গেম খেলা, স্যাটেলাইট চ্যানেলে কার্টুন
দেখা ইত্যাদি। কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনে ‘গেম’ খেলার ‘সময়সূচী’ অবশ্যই
কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া চাই, যার অন্যথা হলে উপযুক্ত শাস্তি তা থেকে
বঞ্চিত করা। তেমনি তারা কোন গেম খেলছে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। তাদের সাথে
খেলায় অংশ নেয়ার মাধ্যমে মা-বাবারও জানা উচিৎ তারা কী খেলছে। শারীরিক
খেলাধূলা ও বইপড়াকে অধিক পরিমাণে উৎসাহিত করতে হবে। ইলেকট্রনিক গেমের
ক্ষেত্রে সময়কে সীমিত করার সাথে সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা যেমন
‘স্ক্র্যাবল’, ‘দাবা’ ইত্যাদিকে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
১৫. সন্তানদের বন্ধুবান্ধব ও প্রিয় মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা
এটি সন্তানের সাথে মা-বাবার দূরত্ব বাড়ায়।
বরং তাদের সাথে পরিচিত হতে হবে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।
যাদের সাথে মেশা মা-বাবা অপছন্দ করছেন, তাদের সাথে মিশতে না দেয়ার কারণ
যৌক্তিকভাবে ও নম্রতার সাথে ব্যাখ্যা করা উচিৎ। বন্ধুদের সাথে তারা কোথায়
কতক্ষণ মিলিত হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোটকথা কাউকে খাটো না করেও
বুদ্ধিমত্তার সাথে বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব – আর সেটাই সঠিক পন্থা।
১৬. সকল সমস্যার ‘রেডি-মেড’ সমাধান হাতে তুলে দেয়া
এক্ষেত্রে তাদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে
তাদেরকে সমস্যা নিয়ে ভাবতে দেয়া ও তাদের প্রস্তাবনা শোনা এবং সে অনুযায়ী
সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতাকে শানিত করবে। এর
বিপরীতে সব সমাধান প্রস্তুত করে দিলে তারা অতিমাত্রায় মা-বাবার ওপর
নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
১৭. কোন শৃঙ্খলা না থাকা
পরিবারে ইবাদত, লেখাপড়া, কাজ, বিনোদন –
সবই থাকবে, কিন্তু সবই নিয়মমাফিক। বিশৃঙ্খলা আজ বহু পরিবারের পরকালীন ও
ইহজাগতিক অধঃপতনের মূল কারণ। পরিবারগুলোতে ঘুমানো, ঘুম থেকে ওঠা, খেতে বসা,
লেখাপড়া, বাইরে যাওয়া, সাক্ষাৎ, বিনোদন – এ সবকিছু সময়সূচী অনুযায়ী
শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে হওয়া উচিৎ এবং এই সময়সূচী কঠোরভাবে আরোপ করা উচিৎ। যেমন:
ছোট বড় সবার বিছানায় যাওয়ার সময় ৯টা। এমনকি ছুটির দিনেও তাই। প্রয়োজনে
ছুটির দিনে ভোর থেকে বাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারে, কিন্তু রাত জেগে ফজরের
সালাত বিলম্বিত করা নয়।
১৮. গালাগাল ও আক্রমণাত্মক কথা
এগুলো একদিকে যেমন সন্তানদেরকে মা-বাবার
প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলে, অন্যদিকে এই স্বভাব তাদের মাঝেও সংক্রমিত হয়।
যাকে আল্লাহ তাআলা মনুষ্যসন্তান হওয়ার মর্যাদা দিয়েছেন, তাকে অন্য কোন
প্রাণীর সাথে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত নোংরা একটি বিষয় – যা কোন মুসলিম তো
দূরে থাক, সামান্য রুচি ও সম্ভ্রমের অধিকারীর পক্ষেও অশোভন।
আর তারা এগুলো শিখে নিয়ে যখন অন্যত্র প্রয়োগ করবে, তখন সবার আগে কার সম্মান খোয়া যায়?
১৯. স্ববিরোধ
ছোট বাচ্চা অতিথিকে মারলে তাকে ধমকানো হয়
কিন্তু মা-বাবা কিংবা বড় ভাইবোনকে মারলে আহ্লাদ দেয়া হয় – এ ধরনের
স্ববিরোধী আচরণের ফলে বাচ্চা ঠিক-ভুল বুঝতে ব্যর্থ হয়।
২০. মা-বাবার ব্যস্ততা
পার্থিব খ্যাতি, সম্পদ কিংবা ক্যারিয়ারের
পেছনে ছুটে সন্তানদেরকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে না পারা আজ সন্তান প্রতিপালনে
ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। সন্তান যখন কাজের লোক, ড্রাইভার, কর্মচারীদের হাতে
বড় হয়, তখন একদিকে সে তাদের কাছ থেকে বহু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ রপ্ত করে,
অন্যদিকে মা-বাবার অভাববোধ থেকে তাঁদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। সে শিশু
হলেও ঠিকই বুঝে নেয় – আমার মায়ের কাছে আমার চেয়ে তাঁর ক্যারিয়ার বেশি
প্রিয়। বাবার কাছে আমার চেয়ে তাঁর বন্ধুবান্ধব বেশি কাছের।
জনৈক পরামর্শদাতার কাছে একজন পরামর্শ
চাইলেন এক ছেলের লেখাপড়ার ব্যাপারে যার মা-বাবা দুজনেই ডাক্তার হওয়ায়
ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত, এদিকে ছেলের লেখাপড়া মাথায় উঠেছে – তারা খুঁজছেন
ভাল স্কুল! পরামর্শদাতার বক্তব্য এটাই ছিল যে সমস্যার মূলে হাত না দিলে
স্কুল খুঁজে লাভ নেই, মাকে আপাতত বাইরে কাজ বাদ দিয়ে ঘর দেখতে হবে। কিন্তু
না! কষ্ট করে তিনি ডাক্তারী পড়েছেন ঘরে বসে থাকার জন্যে? তবে কি ক্যারিয়ারই
সন্তান থেকে দামী?
[ড. জাসিম আল মুতাওআ’ রচিত নিবন্ধের আলোকে রচিত]
……………………………………………………..আপনার সন্তানকে দ্বীনের একজন ‘দাঈ’ হিসেবে গড়তে: ঈমান অ্যারাবিক স্কুল
No comments:
Post a Comment