বদরুদ্দীন উমর test@gmail.com |
সাম্রাজ্যবাদই দুনিয়াজুড়ে সন্ত্রাসী তৎপরতার সংগঠক
25 July 2016, Monday
ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সামরিক হামলা এবং সে দেশটি দখলের
ব্যাপারটি ছিল ঈশপের গল্পে নেকড়ে ও মেষশাবকের মতোই। সেটা যে এরকম ছিল তা
এখন সাম্রাজ্যবাদী মহলেও স্বীকৃত, যদিও এর সত্যতা আগেই তাদের জানা ছিল।
কারণ এ বিষয়ে মিথ্যাটি তারাই সৃষ্টি ও প্রচার করেছিল। সাদ্দাম হোসেনের কাছে
গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এই যুক্তি দেখিয়ে তারা ইরাককে ও নিজেদের ধ্বংসযজ্ঞ
থেকে রক্ষার জন্য ইরাকে সামরিক হামলা করেছিল। সাদ্দাম হোসেন তাদের এই
অভিযোগ বারবার অস্বীকার করা সত্ত্বেও তারা তাদের এই প্রচারণা নিজেদের
প্রচার মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে চালিয়েছিল। নিজেদের অভিযোগের সপক্ষে তারা কোনো
প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি। কারণ প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, ভাইস
প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি ও দেশরক্ষা সচিব ডোলান্ড র্যামসফেল্ড ত্রয়ী অভিন্ন
কণ্ঠে যা বলছিলেন সেটাই ছিল তাদের কাছে প্রমাণতুল্য! তারা বলেছেন, এর থেকে
বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? এক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা ঘটিয়েছিল জাতিসংঘের
পরমাণু ও পর্যবেক্ষক টিম। তারা পুঙ্খাপুঙ্খভাবে সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে তদন্ত
করে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মতো কিছুরই সন্ধান ইরাকে পাননি। টিমের নেতা
হ্যান্স ব্লিক্স খুব জোরের সঙ্গে সে সময় দাবি করেন, তারা যা বলছেন সেটাই
ঠিক। কারণ কোনো ধরনের গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকে থাকলে তারা নিজেদের তদন্তের
মাধ্যমে তার অস্তিত্ব অবশ্যই টের পেতেন। কিন্তু জাতিসংঘের পারমাণবিক
পর্যবেক্ষক দলের এই রিপোর্ট এবং ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অস্তিত্বহীনতার
দাবি সত্ত্বেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও তার তল্পিবাহক
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার জোর গলায় শেষ পর্যন্ত সাদ্দামের হাতে
গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কথা বলে নিজেদের যুদ্ধ চালিয়ে শুধু সাদ্দাম
হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুতই করলেন না, ইরাকের মতো একটি দেশের সুসংহত সমাজকে
একেবারে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস করে দিলেন।
ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও তার সরকারের দাবিকে অসার ও মিথ্যা আখ্যা দিয়ে তার বিরোধিতা আমেরিকাতেও ছিল। নোয়াম চমস্কি থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্কারের সিমুর হার্শ ও মার্ক ডানার, ওয়াশিংটন পোস্টের ওয়ালটার পিনকাস প্রমুখ সাংবাদিক এবং অন্য অনেকে এর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু মার্কিন প্রচারের মূল স্রোতের সরকারি মিথ্যা প্রচারণাই সে সময়ে জনগণের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। যুদ্ধ শেষেও কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র আমেরিকান বা ব্রিটিশরা ইরাকে না পাওয়ায় তাদের কিছুই এসে গেল না! মিথ্যা স্বীকার করা তো দূরের কথা, বিষয়টিকে একটা ভুল হিসেবে স্বীকার করে তার জন্য ইরাকের জনগণ ও সেই সঙ্গে নিজেদের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও তাদের মধ্যে দেখা গেল। তাদের মিথ্যা দুনিয়ার কাছে ধরা পড়ে গেলেও ধাপ্পাবাজির জন্য দেশবাসীও তাদের কোনো শাস্তি দেয়নি। উপরন্তু প্রেসিডেন্ট বুশ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার উভয়েই পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন! এর দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমের শক্তি ও মহিমাই প্রমাণিত হয়েছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদীদের মিথ্যা প্রচারণা কীভাবে জনগণের ওপর প্রবল ও প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে তাদের মগজ ধোলাই করতে সক্ষম।
এ বিষয়ে অন্য আলোচনার আগে এ প্রশ্ন তোলা দরকার যে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে যদি গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকত তাহলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশের পক্ষে ইরাক আক্রমণের কী যুক্তি থাকতে পারে? ইরাক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনে পারমাণবিক থেকে নিয়ে অন্য যে কোনো অস্ত্র তৈরি ও মজুদ রাখতে পারে। যেমন সেটা পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভারত ও পাকিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ইসরাইল ইত্যাদি দেশে পারমাণবিক অস্ত্র এমন বড় আকারে মজুদ রাখা আছে যে তাকে শুধু গণবিধ্বংসীই বলা চলে না, তার দ্বারা সারা দুনিয়াকে হাজার হাজারবার ধ্বংস করা যায়। কাজেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি ও তা নিজের হাতে রাখার মধ্যে দোষের কিছু নেই! এক্ষেত্রে দোষ দাঁড়ায় তখনই যখন শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বা তাদের কোনো মক্কেল রাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্য এমন কোনো রাষ্ট্রের হাতে সেটা থাকে, যা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসুবিধাজনক! এদিক দিয়ে বিচার করলে আন্তর্জাতিক আইন থেকে নিয়ে কোনো নৈতিক বিবেচনা অনুসারেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকের হাতে আছে, এই যুক্তিতে ইরাক আক্রমণ, দখল ও দেশটিকে ধ্বংস করে ছিন্নভিন্ন করা যায় না। কাজেই এভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সে দেশটি দখল করে, সে দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যা করেছিল, তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। নোয়াম চমস্কি ইরাকে মার্কিন সামরিক হামলাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করায় তাকে সরকারিভাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বেঈমান হিসেবে!
বিগত ৬ জুলাই ব্রিটেনে চিলকট (Chilcot) তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্রিটেন কর্তৃক ইরাক আক্রমণের বিষয়ে অতি বিস্তারিতভাবে তথ্য উপস্থিত করা হয়েছে। প্রায় ছয়শ’ হাজার পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বলে কিছু ছিল না। এ বিষয়ে টনি ব্লেয়ার ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ধামাধরা হিসেবেই ব্রিটেনকে ইরাক যুদ্ধে জড়িত করেছিলেন। আসলে ইরাকের সম্পদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরাককে একটি মার্কিনবিরোধী দেশ হিসেবে উচ্ছেদ করাসহ অন্যান্য কারণে জর্জ ডব্লিউ বুশ এই মিথ্যা তৈরি করেছিলেন এবং টনি ব্লেয়ারকে তাদের অপরাধমূলক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এদিক দিয়ে বলা চলে, বুশ ও ব্লেয়ার শুধু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পরিচালক নয়, অন্য কথা বাদ দিয়ে নিজেদের দেশের লোকদেরও নিজেদের মিথ্যা জালে আটকে রেখে তারা প্রতারিত করেছিলেন। এ হিসেবে তারা যুদ্ধাপরাধী ছাড়া আর কী?
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ দরকার। ইরাক আক্রমণের জন্য সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এই অজুহাত খাঁড়া করেছিল? এটা ছিল এক সর্বৈব মিথ্যা। এ নিয়ে এখন কারও কোনো সন্দেহ নেই। চিলকট তদন্ত রিপোর্টে যা পাওয়া গেছে সেটি পাওয়া যাবে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কোনো তদন্ত হয়। অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগে অন্য এক কাহিনীর ভিত্তিতে, সেটাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করেছিল। কিন্তু খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সেই অজুহাতকে মিথ্যা বলে তেমন কারও মনে হয় না, কিছু ব্যতিক্রমী মহল ছাড়া। কাজেই এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীরা পর্যন্ত ধরে নিয়েছেন যে, আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনই নিউইয়র্কে ট্রেড সেন্টারে এবং ওয়াশিংটনে বিমান হামলা করেছিলেন। অথচ এটা এক অকাট্য সত্য যে, ৯/১১-এর সন্ত্রাসী বিমান হামলাকে অজুহাত হিসেবে উপস্থিত করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করেছিল। এই বিমান হামলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভেতরের কাজ (inside job) বলে আমরা প্রথম থেকেই আখ্যায়িত করে এসেছি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো মহলে একে আখ্যায়িত করা হয়েছিল একইভাবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণা এমনই ব্যাপক, প্রচণ্ড ও শক্তিশালী যে, ৯/১১-এর ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সংগঠিত ভেতরের কাজ বলে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত হয়নি, যেভাবে সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকার বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে।
লক্ষ করার বিষয়, ৯/১১-এর ঘটনা ঘটার পর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ তার এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানে বসেই ঘোষণা করেছিলেন, সেটা ওসামা বিন লাদেনের কাজ! কোনো তদন্ত ছাড়াই ঘটনার মুহূর্তমাত্র দেরি না করে কীভাবে প্রেসিডেন্ট বুশ এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, আফগানিস্তানের গুহায় লুকিয়ে থাকা বিন লাদেন ৯/১১-এর মতো জটিল এবং ঘনিষ্ঠ তদারকি সাপেক্ষে সামরিক অপারেশনটি করেছেন? এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা দরকার যে, এত বড় ঘটনা যাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু করলেন, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত তারা করলেন না। পরে তদন্তের নামে তারা যা করেছিলেন তার মধ্যে নির্ভরযোগ্য কিছুই ছিল না এবং তার দ্বারা ৯/১১-এর ঘটনার সঙ্গে বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রকৃত প্রমাণই পাওয়া যায়নি। আফগানিস্তানের গুহায় বসে নিরাপত্তার কারণে মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক বছর ধরে মার্কিন বিশাল ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী বিমান হামলাকারীদের ট্রেনিং এবং চারটি বিমান ব্যবহার করে ৯/১১-এর হামলা কীভাবে সম্ভব হল, এ প্রশ্ন কেউ গুরুত্বের সঙ্গে তুলল না, কেউ বিবেচনা করল না! আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে সত্য সন্ধানে কেউ তদন্তে এগিয়ে এলো না এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারণাকেই শিরোধার্য করে সবাই বসে রইল, এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। ব্রিটেনে চিলকট রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাক যুদ্ধ নিয়ে এ ধরনের তদন্তের কথা এখন অনেকে বলছেন। কিন্তু ৯/১১-এর বিমান হামলা নিয়েও যে তদন্ত হওয়া দরকার, যে অজুহাত খাড়া করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল সেই অজুহাতের সত্যাসত্যও যে যাচাই করা দরকার, এর প্রয়োজন অস্বীকার করার কী আছে? ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মতো মিথ্যা যারা তৈরি ও প্রচার করে ইরাক আক্রমণ করেছিল, তাদের ৯/১১-এর সম্ভাব্য হামলা বিষয়ে ছাড় দেয়ার কী কারণ থাকতে পারে? এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে এবং অন্যত্র করাও হয়েছে; কিন্তু প্রসঙ্গত বিষয়টি এখানে উল্লেখ করলেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন এখানে নেই।
ইরাক যুদ্ধের বিষয়ে ফিরে গিয়ে এটা বলা দরকার যে, সে যুদ্ধের পরিকল্পনা জর্জ ডব্লিউ বুশ, ডিক চেনি এবং ডোনাল্ড রামসফেল্ড ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই করেছিলেন। তারা তিনজন বিশাল তেল ব্যবসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলো দখল করার পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেও ইরাক দখল করার প্রয়োজন তাদের ছিল। ডিক চেনি আগেই পরিকল্পনা করেছিলেন ইরাক দখল করে তাকে শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি এই তিন অংশে বিভক্ত করার। এই উদ্দেশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখনও আছে। ইতিমধ্যেই কুর্দিরা নিজেদের অঞ্চলে নিজেদের শাসন কায়েম করেছেন। ইরাকের পরিস্থিতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ইরাক শিয়া ও সুন্নি অংশে বিভক্ত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্রিটেনে চিলকট রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বর্তমান ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, ইরাকে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। তারা সেখানে সাদ্দামের সামরিক বাহিনী দিয়ে চার লাখ সৈন্যকে বেকার করে এবং অন্যভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তার থেকেই জন্ম নিয়েছে ইসলামী স্টেট (আইএস)। ২০১৫ সালে Vice News পত্রিকায় প্রেসিডেন্ট ওবামা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'ISIL is direct outgrowth of Al-Qaeda in Iraq that grew out of our invasion, which is an example of unintended consequences. অর্থাৎ আইএসআইএল আমাদের আক্রমণের পর ইরাকে আল কায়দার থেকে সরাসরি গড়ে উঠেছিল। এটা ছিল অনভিপ্রেত ফলাফলের এক দৃষ্টান্ত। নিজেদের সাফাই গাওয়ার জন্য ওবামা একে অনভিপ্রেত বললেও এসবই ছিল প্রেসিডেন্ট বুশদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এ আলোচনা শেষ করার আগে বলা দরকার, ৯/১১-এর পর আফগানিস্তান আক্রমণ এবং ইরাকে সামরিক হামলা ও তা দমনের পর থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্মকাণ্ডই যে দুনিয়াজুড়ে এখন সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য দায়ী, এর স্পষ্ট স্বীকৃতিই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে নিহিত আছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের সাম্রাজ্যবাদী মিত্রমণ্ডলী ও তাদের মক্কেল রাষ্ট্রগুলোতে এখন সন্ত্রাস দমনের নামে জনগণের ওপর দমন নীতি চালিয়ে যাওয়ার যে কাজ চলছে, সেটা মহা দুষ্টের দ্বারা তাদেরই সৃষ্ট এবং অধীনস্থ ছোট দুষ্ট দমনের এক ধাপ্পাবাজি কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ও তার সরকারের দাবিকে অসার ও মিথ্যা আখ্যা দিয়ে তার বিরোধিতা আমেরিকাতেও ছিল। নোয়াম চমস্কি থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্কারের সিমুর হার্শ ও মার্ক ডানার, ওয়াশিংটন পোস্টের ওয়ালটার পিনকাস প্রমুখ সাংবাদিক এবং অন্য অনেকে এর প্রতিবাদ করেন। কিন্তু মার্কিন প্রচারের মূল স্রোতের সরকারি মিথ্যা প্রচারণাই সে সময়ে জনগণের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। যুদ্ধ শেষেও কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র আমেরিকান বা ব্রিটিশরা ইরাকে না পাওয়ায় তাদের কিছুই এসে গেল না! মিথ্যা স্বীকার করা তো দূরের কথা, বিষয়টিকে একটা ভুল হিসেবে স্বীকার করে তার জন্য ইরাকের জনগণ ও সেই সঙ্গে নিজেদের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও তাদের মধ্যে দেখা গেল। তাদের মিথ্যা দুনিয়ার কাছে ধরা পড়ে গেলেও ধাপ্পাবাজির জন্য দেশবাসীও তাদের কোনো শাস্তি দেয়নি। উপরন্তু প্রেসিডেন্ট বুশ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার উভয়েই পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন! এর দ্বারা সাম্রাজ্যবাদী প্রচার মাধ্যমের শক্তি ও মহিমাই প্রমাণিত হয়েছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদীদের মিথ্যা প্রচারণা কীভাবে জনগণের ওপর প্রবল ও প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে তাদের মগজ ধোলাই করতে সক্ষম।
এ বিষয়ে অন্য আলোচনার আগে এ প্রশ্ন তোলা দরকার যে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে যদি গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকত তাহলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশের পক্ষে ইরাক আক্রমণের কী যুক্তি থাকতে পারে? ইরাক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা অথবা অন্য কোনো প্রয়োজনে পারমাণবিক থেকে নিয়ে অন্য যে কোনো অস্ত্র তৈরি ও মজুদ রাখতে পারে। যেমন সেটা পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভারত ও পাকিস্তান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ইসরাইল ইত্যাদি দেশে পারমাণবিক অস্ত্র এমন বড় আকারে মজুদ রাখা আছে যে তাকে শুধু গণবিধ্বংসীই বলা চলে না, তার দ্বারা সারা দুনিয়াকে হাজার হাজারবার ধ্বংস করা যায়। কাজেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি ও তা নিজের হাতে রাখার মধ্যে দোষের কিছু নেই! এক্ষেত্রে দোষ দাঁড়ায় তখনই যখন শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র বা তাদের কোনো মক্কেল রাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্য এমন কোনো রাষ্ট্রের হাতে সেটা থাকে, যা সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসুবিধাজনক! এদিক দিয়ে বিচার করলে আন্তর্জাতিক আইন থেকে নিয়ে কোনো নৈতিক বিবেচনা অনুসারেই গণবিধ্বংসী অস্ত্র ইরাকের হাতে আছে, এই যুক্তিতে ইরাক আক্রমণ, দখল ও দেশটিকে ধ্বংস করে ছিন্নভিন্ন করা যায় না। কাজেই এভাবে ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, সে দেশটি দখল করে, সে দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন যা করেছিল, তাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। নোয়াম চমস্কি ইরাকে মার্কিন সামরিক হামলাকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে আখ্যায়িত করায় তাকে সরকারিভাবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল বেঈমান হিসেবে!
বিগত ৬ জুলাই ব্রিটেনে চিলকট (Chilcot) তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ব্রিটেন কর্তৃক ইরাক আক্রমণের বিষয়ে অতি বিস্তারিতভাবে তথ্য উপস্থিত করা হয়েছে। প্রায় ছয়শ’ হাজার পৃষ্ঠার এই রিপোর্টে প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র বলে কিছু ছিল না। এ বিষয়ে টনি ব্লেয়ার ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলেছিলেন এবং প্রকৃতপক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ধামাধরা হিসেবেই ব্রিটেনকে ইরাক যুদ্ধে জড়িত করেছিলেন। আসলে ইরাকের সম্পদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইরাককে একটি মার্কিনবিরোধী দেশ হিসেবে উচ্ছেদ করাসহ অন্যান্য কারণে জর্জ ডব্লিউ বুশ এই মিথ্যা তৈরি করেছিলেন এবং টনি ব্লেয়ারকে তাদের অপরাধমূলক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এদিক দিয়ে বলা চলে, বুশ ও ব্লেয়ার শুধু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পরিচালক নয়, অন্য কথা বাদ দিয়ে নিজেদের দেশের লোকদেরও নিজেদের মিথ্যা জালে আটকে রেখে তারা প্রতারিত করেছিলেন। এ হিসেবে তারা যুদ্ধাপরাধী ছাড়া আর কী?
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ দরকার। ইরাক আক্রমণের জন্য সাদ্দাম হোসেনের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, এই অজুহাত খাঁড়া করেছিল? এটা ছিল এক সর্বৈব মিথ্যা। এ নিয়ে এখন কারও কোনো সন্দেহ নেই। চিলকট তদন্ত রিপোর্টে যা পাওয়া গেছে সেটি পাওয়া যাবে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের কোনো তদন্ত হয়। অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তার আগে অন্য এক কাহিনীর ভিত্তিতে, সেটাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সাম্রাজ্যবাদী মিত্রদের নিয়ে আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করেছিল। কিন্তু খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার যে, সেই অজুহাতকে মিথ্যা বলে তেমন কারও মনে হয় না, কিছু ব্যতিক্রমী মহল ছাড়া। কাজেই এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীরা পর্যন্ত ধরে নিয়েছেন যে, আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনই নিউইয়র্কে ট্রেড সেন্টারে এবং ওয়াশিংটনে বিমান হামলা করেছিলেন। অথচ এটা এক অকাট্য সত্য যে, ৯/১১-এর সন্ত্রাসী বিমান হামলাকে অজুহাত হিসেবে উপস্থিত করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ ও দখল করেছিল। এই বিমান হামলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ভেতরের কাজ (inside job) বলে আমরা প্রথম থেকেই আখ্যায়িত করে এসেছি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো মহলে একে আখ্যায়িত করা হয়েছিল একইভাবে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী প্রচারণা এমনই ব্যাপক, প্রচণ্ড ও শক্তিশালী যে, ৯/১১-এর ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সংগঠিত ভেতরের কাজ বলে এখন পর্যন্ত স্বীকৃত হয়নি, যেভাবে সাদ্দাম হোসেনের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র না থাকার বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছে।
লক্ষ করার বিষয়, ৯/১১-এর ঘটনা ঘটার পর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ তার এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানে বসেই ঘোষণা করেছিলেন, সেটা ওসামা বিন লাদেনের কাজ! কোনো তদন্ত ছাড়াই ঘটনার মুহূর্তমাত্র দেরি না করে কীভাবে প্রেসিডেন্ট বুশ এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, আফগানিস্তানের গুহায় লুকিয়ে থাকা বিন লাদেন ৯/১১-এর মতো জটিল এবং ঘনিষ্ঠ তদারকি সাপেক্ষে সামরিক অপারেশনটি করেছেন? এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা দরকার যে, এত বড় ঘটনা যাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু করলেন, সে বিষয়ে কোনো তদন্ত তারা করলেন না। পরে তদন্তের নামে তারা যা করেছিলেন তার মধ্যে নির্ভরযোগ্য কিছুই ছিল না এবং তার দ্বারা ৯/১১-এর ঘটনার সঙ্গে বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রকৃত প্রমাণই পাওয়া যায়নি। আফগানিস্তানের গুহায় বসে নিরাপত্তার কারণে মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাকে ফাঁকি দিয়ে একাধিক বছর ধরে মার্কিন বিশাল ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী বিমান হামলাকারীদের ট্রেনিং এবং চারটি বিমান ব্যবহার করে ৯/১১-এর হামলা কীভাবে সম্ভব হল, এ প্রশ্ন কেউ গুরুত্বের সঙ্গে তুলল না, কেউ বিবেচনা করল না! আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে সত্য সন্ধানে কেউ তদন্তে এগিয়ে এলো না এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারণাকেই শিরোধার্য করে সবাই বসে রইল, এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। ব্রিটেনে চিলকট রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাক যুদ্ধ নিয়ে এ ধরনের তদন্তের কথা এখন অনেকে বলছেন। কিন্তু ৯/১১-এর বিমান হামলা নিয়েও যে তদন্ত হওয়া দরকার, যে অজুহাত খাড়া করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করেছিল সেই অজুহাতের সত্যাসত্যও যে যাচাই করা দরকার, এর প্রয়োজন অস্বীকার করার কী আছে? ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মতো মিথ্যা যারা তৈরি ও প্রচার করে ইরাক আক্রমণ করেছিল, তাদের ৯/১১-এর সম্ভাব্য হামলা বিষয়ে ছাড় দেয়ার কী কারণ থাকতে পারে? এ বিষয়ে অনেক আলোচনা হতে পারে এবং অন্যত্র করাও হয়েছে; কিন্তু প্রসঙ্গত বিষয়টি এখানে উল্লেখ করলেও এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন এখানে নেই।
ইরাক যুদ্ধের বিষয়ে ফিরে গিয়ে এটা বলা দরকার যে, সে যুদ্ধের পরিকল্পনা জর্জ ডব্লিউ বুশ, ডিক চেনি এবং ডোনাল্ড রামসফেল্ড ২০০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই করেছিলেন। তারা তিনজন বিশাল তেল ব্যবসার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলো দখল করার পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেও ইরাক দখল করার প্রয়োজন তাদের ছিল। ডিক চেনি আগেই পরিকল্পনা করেছিলেন ইরাক দখল করে তাকে শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি এই তিন অংশে বিভক্ত করার। এই উদ্দেশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখনও আছে। ইতিমধ্যেই কুর্দিরা নিজেদের অঞ্চলে নিজেদের শাসন কায়েম করেছেন। ইরাকের পরিস্থিতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে শেষ পর্যন্ত উত্তর ও দক্ষিণ ইরাক শিয়া ও সুন্নি অংশে বিভক্ত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
ব্রিটেনে চিলকট রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বর্তমান ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড বলেছেন, ইরাকে ইসলামিক স্টেটের উত্থানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। তারা সেখানে সাদ্দামের সামরিক বাহিনী দিয়ে চার লাখ সৈন্যকে বেকার করে এবং অন্যভাবে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, তার থেকেই জন্ম নিয়েছে ইসলামী স্টেট (আইএস)। ২০১৫ সালে Vice News পত্রিকায় প্রেসিডেন্ট ওবামা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'ISIL is direct outgrowth of Al-Qaeda in Iraq that grew out of our invasion, which is an example of unintended consequences. অর্থাৎ আইএসআইএল আমাদের আক্রমণের পর ইরাকে আল কায়দার থেকে সরাসরি গড়ে উঠেছিল। এটা ছিল অনভিপ্রেত ফলাফলের এক দৃষ্টান্ত। নিজেদের সাফাই গাওয়ার জন্য ওবামা একে অনভিপ্রেত বললেও এসবই ছিল প্রেসিডেন্ট বুশদের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
এ আলোচনা শেষ করার আগে বলা দরকার, ৯/১১-এর পর আফগানিস্তান আক্রমণ এবং ইরাকে সামরিক হামলা ও তা দমনের পর থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্মকাণ্ডই যে দুনিয়াজুড়ে এখন সন্ত্রাসী তৎপরতার জন্য দায়ী, এর স্পষ্ট স্বীকৃতিই ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে নিহিত আছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তাদের সাম্রাজ্যবাদী মিত্রমণ্ডলী ও তাদের মক্কেল রাষ্ট্রগুলোতে এখন সন্ত্রাস দমনের নামে জনগণের ওপর দমন নীতি চালিয়ে যাওয়ার যে কাজ চলছে, সেটা মহা দুষ্টের দ্বারা তাদেরই সৃষ্ট এবং অধীনস্থ ছোট দুষ্ট দমনের এক ধাপ্পাবাজি কর্মকাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
No comments:
Post a Comment